খেলাঘরখেলাঘর

মাঁসিয়ার প্যাঁরি

দু একদিন পর এক সকালে থুতনির দাড়িটাকে যথা সম্ভব সাবধানে ছাঁটতে ছাঁটতে আমাকে নিয়ে পড়লো,
‘বুঝলি, এই দাড়িকে ফরাসিরা বলে গোঁতে অবশ্য তোরা ইংরেজের লেজধরারা বলবি গোটে। এই দাড়ির মর্ম তোরা বুঝলি না তাই আমাদের দেশের এই অবস্থা।’
তবে বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর নমামার করুণ মুখ দেখে আমারই কষ্ট হলো। কোন কথা না বলে সোজা বাথরুমে গিয়ে নির্মম ভাবে নিজের হাতে ওই গোঁতেকে কামিয়ে ফেলে ঘরে এসে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অনেক ক্ষণ সাধা সাধির পর টুকরো টাকরা কথা থেকে আজকের অফিসের ব্যাপারটা বোঝা গেলো। দুপুরে লাঞ্চের সময় ন'মামা একা বসে ফরাসিদের মত স্যাণ্ডউইচ আর কফি খাচ্ছিলো তখনই অনিন্দিতা এক ঠোঙ্গা ঝাল মুড়ি খেতে খেতে এসে পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। তারপর কিছু সময় এক দৃষ্টিতে ন'মামার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘প্যাঁরি, তোমার দাড়ির উন্নতির দিকে আমি কদিন ধরেই নজর রাখছি – দুদিন আগেও কুড়িটা ছিলো আজ দেখছি চব্বিশটা হয়েছে। এই তো চাই – তোমার ফরাসি হতে আর বেশী দেরি নেই - এভাবেই চালিয়ে যাও।’
অনিন্দিতার কথা ও ওই হাসি ন'মামার একেবারে মর্মে গিয়ে আঘাত করেছে তাই বাড়ি ফিরেই এই গোঁতের সমূলে বিনাশ।

রবিবার বিকেলে দেখি ন'মামা মার কোল ঘেঁসে বসে আবদার করছে,
‘বুঝলে বড়দি, আমাদের বাঙ্গালীদের খাওয়াটা শরীর, স্বাস্থ্য ও বুদ্ধির জন্য ঠিক উপযুক্ত নয় – তেল মশলা দিয়ে রান্না করে আমরা তরি তরকারির আসল গুণ গুলোকে নষ্ট করে ফেলি। দেখলাম ফরাসিরা না এ ব্যাপারে খুব সচেতন – ওরা সব তরকারি সেদ্ধর সুপ খায় ওতে তরকারির আসল গুণ গুলো থেকে যায় – তাই তো ওরা এত উন্নত জাতি। বড়দি, কাল থেকে না আমাকে সব তরকারির সুপ করে দিও – অফিস যাবার আগে ওই সুপ আর পাওরুটি খেয়ে যাবো। দেখবে দুদিনে তোমার পল্টুর চেহারা কেমন পালটে গিয়েছে।’সন্ধ্যায় মা ন'মামার সুপের ব্যাপারটা বাবাকে বলতে বাবা মুচকি হেসে বললেন,
‘পল্টু খুব একটা খারাপ বলে নি – তরকারির নির্য্যাসে নিশ্চয়ই সব গুলো ভিটামিন থাকে। তুমি এক কাজ করো – পল্টুকে সব রকম তরকারি দিয়ে সুপ করে দিও। ওতে হেলেঞ্চা শাক, পালং শাক, উচ্ছে, পটল, আলু, মূলো, কচু, কুমড়ো সব কিছুই দিও যাতে পল্টু সব রকমের ভিটামিনই পায়। কাল সকালে বাজার থেকে আমি সব রকম তরকারি আর পাওরুটি নিয়ে আসবো।’ 
পরদিন সকালে আমরা কলেজ অফিস যাবার জন্য খাবার টেবিলে বসলে ন'মামা দেখি একেবারে সুট টাই পরে এসে টেবিলে বসে ন্যাপকিন না থাকায় মার পরিষ্কার ঝাড়নের কাপড়টা গলায় বেঁধে নিলো যেমন সিনেমাতে দেখা যায়। আনন্দে মুখ ঝক ঝক করছে – সামনে ডান দিকে প্লেটে কোয়ার্টার পাউন্ড পাওরুটি সাজানো আর তার পাশে সুপের চামচ না থাকার জন্য একটা বড় চামচ রাখা – আরেক পাশে নুন আর গোলমরিচের গুড়ো। আমার ও বাবার ভাত তরকারি দিয়ে মা একটা জাম বাটিতে এক বাটি ধোঁয়া ওঠা সুপ নিয়ে নমামার সামনে রাখলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক প্রেসার কুকারে সেদ্ধ করার ফলে সব তরকারি গলে গিয়ে কেমন একটা কালচে থকথকে চেহারা নিয়েছে আর যে গন্ধ বেরুচ্ছে তাতে আমি বাবার দিকে একটা চেয়ার সরে গেলাম। বাবা আড় চোখে ব্যাপারটা দেখে মুখের হাসি লুকিয়ে নিজের খাওয়াতে মন দিলেন তবে দেখলাম বাবার নজরটা ন'মামার দিকেই। সুপের গন্ধে ন'মামার নাকটা কুঁচকে গেলেও মুখে হাসি টেনে মাকে বললো,
‘বুঝলে বড়দি, এই হলো আসল জিনিষ – সমস্ত তরকারির নির্য্যাস মানে গুণ এতে আছে।’
ধীরে ধীরে বড় চামচ দিয়ে থকথকে জিনিসটাকে ভালো করে নাড়িয়ে তাতে নুন ও গুলমরিচের গুড়ো মিশিয়ে এক চামচ তুলে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করতে শুরু করলো তবে নাকের কুঁচকানো ভাবটা কমলো না। খাওয়া ভুলে আমি রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছি ন'মামার দিকে। একটু ঠাণ্ডা হতে পুরো চামচটা ন'মামার মুখের মধ্যে – তারপরই স্লো মোসন সিনেমার মত ন'মামার মুখটা কেমন যেন পালটে যেতে শুরু করলো – গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে চোয়াল শক্ত করে ঠোঁট চেপে আছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, গলা ওঠা নামা করছে কিন্তু মুখের জিনিসটা নিচে নামছে না। বাবাও খাওয়া বন্ধ করে নমামাকে দেখছেন – মার চোখে মুখে ভয়ের ভাব। আধ মিনিটও নয় তারপর এক ঝটকায় চেয়ারটা ঠেলে মুখে ঝাড়নের কাপড়টা চেপে উঠতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় বাটির সুপ উলটে ন'মামার সুট, সার্ট, টাই একেবারে মাখামাখি – ওই অবস্থাতেই দৌড়ালো বাথরুমের দিকে তবে মাঝ রাস্তা থেকে আর সামলাতে পারলো না – ওয়াক করে মুখের সমস্ত কিছু ছিটকে বেরিয়ে এলো তারপর আধ ঘন্টা ধরে শুধু বমির আওয়াজ। বাবা আস্তে আস্তে বললেন,
‘পল্টুর ট্রিটমেন্টটা একটু জোরদারই হয়ে গিয়েছে মনে হয়।’
তবে এর পর থেকে ন'মামা আবার পুরো দস্তুর বাঙ্গালী হয়ে গেলো।


অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক