সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পেঁচোর গুপ্তধন সন্ধান

তখনকার মতো সমস্যাটা ভুলে সন্ধ্যাটা বেশ আড্ডা মেরে কাটানো হল। ডিনারের কিছুক্ষণ পর কাকা শুতে গেলেন আর সাথে সাথেই পেঁচো চোখের ইশারায় আমাকে ওদের ঘরে যেতে বলল। কুহেলি আগেই সেখানে মজুত। এবার তিনজনে রুদ্ধশ্বাস কনফারেন্স বসল।
"পেছন দরজার চাবি, সেটা দিয়ে কী হবে সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায় না।" পেঁচোই শুরু করল।
বললাম, "নিশ্চয়ই দরজার ভেতরে সেই বিশেষ জিনিসটি আছে। নইলে আর চাবি কেন?"
"ঠিক বলেছিস। কিন্তু গবুচন্দ্র, সেখানে তো চাবি ছাড়াও বাড়ির ভেতর দিয়ে যাওয়া যেত।"
ঠিক, ঠিক! ভেবড়ে গিয়ে বললাম, "তাহলে –"
"যদি ঐ দরজার কাছাকাছি ঝোপজঙ্গলে কোনও জিনিস থাকে?" এবার কুহেলি বলল।
পেঁচো মুচকি হেসে বলল, "কিন্তু ডিয়ার, ওখানেও তো সামনের দরজা খুলেই যাওয়া যায়।"
"তাও তো বটে!" কুহেলি একটু ভেবে আবার বলল, "তবে আমার মনে হচ্ছে, পেছন দরজার ঠিক বাইরে কী যেন একটা ছিল। কী যেন রাখা থাকত।"
পেঁচো উৎসুকভাবে বলল, "কী, একটু ভেবে দ্যাখো না?"
"ভাবছি। তবে মনে করতে হলে বোধহয় একবার ওখানে যেতে হবে।"
"কিন্তু সেটা তো এই অন্ধকারে সম্ভব নয়। কাল সকালে দেখা যাবে।" আমি বললাম, "তার চেয়ে এখন শুয়ে পড়। কাল আবার বেরোনো আছে।"
"কুহেলির যদি ব্যাপারটা মনে পড়ে যায়, তবে কাল বেরোবার আগেই আমাদের দ্বিতীয় ক্লু-র সমাধান হয়ে যাবে।" দৃঢ়স্বরে বলল পেঁচো।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল পেঁচোর খোঁচায়। ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি, বাইরে ঊষার আলো। পেঁচোর পেছনে কুহেলিও রেডি। নবদম্পতি আমার আগে উঠে পড়েছে দেখে লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি জামাটা গলিয়ে চুলটা আঙুল দিয়েই যথাসাধ্য সেট করে ওদের সামিল হলাম।
"মনে আছে তো, পেছনের দরজায় যেতে হবে।" পেঁচো বলল।
বললাম, "কিন্তু কাকা কি উঠেছেন? সদরের চাবি?"
"সদরে তালা দেওয়া থাকে না। আমরা ল্যাচ টেনে বেরিয়ে যাব।" কুহেলি বলল।
"কিন্তু ফেরার সময় কাকার ঘুম ভাঙাবে?"
পেঁচো হাতে ধরা পেছন দরজার চাবিটা দেখিয়ে মুচকি হেসে বলল, "এটা রয়েছে কী করতে?"
পেছন দরজার কাছে এসে পেঁচো হঠাৎ মাটিতে ঝুঁকে পড়ে বলল, "এই দ্যাখ, দেওয়ালের পাশে নরম মাটিতে পাশাপাশি গোলমতো দুটো গর্ত। এগুলো –"
"মই!" কুহেলি হঠাৎ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, "মনে পড়েছে, এখানে একটা মই রাখা থাকত। কিন্তু এখন দেখছি না।"
"দাগটা তাজা। অর্থাৎ মইটা খুব সম্প্রতিও এখানে ছিল।" পেঁচো বলল, "কে জানে, হয়তো গতকালই সরানো হয়েছে – বোধহয় এই ক্লু-টা দেওয়া হবে না দেখে।"
"কিন্তু মই লাগিয়ে আমরা কোথায় পৌঁছোব?" অধৈর্য হয়ে বললাম, "সেই প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে – জায়গাটা বাইরে হোক ভেতরে হোক, চাবি ছাড়াই তো পৌঁছনো যেত?"
"দেখিয়ে দিচ্ছি।" বলে এক গাল হেসে পেঁচো দরজার তালাটা খুলে ফেলল। তারপর দরজা সরিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল, "যা ভেবেছি, তাই।"
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরাও দেখতে পেলাম – ঠিক দরজার কাছেই ছাদের একটু নিচে আজেবাজে জিনিস রাখার এক ফালি জায়গা, যাকে ইংরেজিতে বলে 'লফ্‌ট'। বাইরের তালার চাবি আর মইয়ের তাৎপর্য এবার স্পষ্ট হল – ওই ফাঁকটা ভেতর থেকে নজরে পড়ে না, শুধু বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়। আর দরজাটা না খুললে ওটুকু সঙ্কীর্ণ জায়গায় মই লাগানোও সহজ নয়।
"সমস্যার তো সমাধান হল। কিন্তু উঠবার মইটা যে নেই। তাহলে কি কাকা উঠলে জিগ্যেস করব?"
"কভি নেহি!" পেঁচো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, "উনি যদি ভেবে থাকেন মই লুকিয়ে আমাদের আটকে দেবেন তাহলে ভুল করেছেন।"
বললাম, "আমাদের কারও হাত অত উঁচুতে পৌঁছবে না।"
"দ্যাখ এই মাথার থেকে কী আইডিয়া বেরোয়।" পেঁচো গর্বিত হাসি হেসে কুহেলির দিকে ফিরে বলল, "আমি উবু হয়ে বসছি, তুমি আমার ঘাড়ে ওঠো। তারপর আমি উঠে দাঁড়ালেই তুমি দেখতে পাবে ওখানে খাস চিজ কী আছে।"
কুহেলি ফিক করে হেসে বলল, "আমাকে ফেলে দেবে না তো?"
"তাই কি পারি, ডিয়ার? আচ্ছা বেশ, গবু নয় আমায় ধরে থাকবে।"
"কিন্তু ওখানে তো অজস্র আজেবাজে জিনিস থাকবে। তার মধ্যে কোনটা –"
"তোমার বিচারবুদ্ধিতে আমার আস্থা আছে। তুমি গন্ধ শুঁকে ঠিক ধরে ফেলবে।"
শুনেই কুহেলি চিড়বিড়িয়ে উঠল, "শুঁকব কি গো, লফ্‌টে নিশ্চয়ই ভীষণ ধুলো!"
"তোমার ওড়নাটা নাকেমুখে জড়িয়ে নাও।"
এভাবে প্রস্তুতিপর্ব শেষ হওয়ার পর পেঁচো সত্যিই কাঁধে করে কুহেলিকে লফ্‌ট অবধি তুলে ধরল। তারপর শোনা গেল কুহেলির বিস্ময়মাখা কণ্ঠস্বর, "আরে, জায়গাটা তো সাফসুতরো। শুধু একটা ছোটো বাক্স রয়েছে।"
"মই কেড়ে নিলেও কাকা আমাদের অন্তত এই উপকারটুকু করে রেখেছেন। ঠিক আছে, এবার ওটা নিয়ে নেমে এসো।"
কুহেলি নামলে আমরা বাক্সটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওটা খোলা, ভেতরে একটা ধাতুর ফলক গোছের জিনিস। পেঁচো ওটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। তারপর বলল, "চলো, ঘরে গিয়ে ভালো করে দেখব।"
ঠিক হল, কাকাকে এ নিয়ে কিছু বলা হবে না। আমি পেছন দরজায় বাইরে থেকে তালা মেরে সামনের দরজায় আসব আর কুহেলি সেটা খুলে দেবে। কিন্তু যেই বাইরে পা দিয়েছি, প্রাণখোলা হাসির শব্দে পেছন ফিরে দেখি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাকা। আমাদের কার্যকলাপ এতক্ষণ সকৌতুকে লক্ষ করছিলেন।
"বাঃ, তাহলে তোমরা দ্বিতীয় ধাঁধাটারও সমাধান করে ফেলেছ! তবে জ্যোতির্ময়, তোমার পদ্ধতিতে কিন্তু বলতে হবে বেশ অভিনবত্ব আছে। বিবাহ মানে বিশেষরূপে বহন। কিন্তু সেটা এভাবে আক্ষরিক অর্থে –" বলে তিনি আবার হাসিতে ফেটে পড়লেন। তারপর একটু থেমে বললেন, "আমার মতো সাধারণ বুদ্ধির মানুষ হলে অবশ্য স্রেফ একটা চেয়ার-টেয়ার টেনে নিত।"
আমি আর পেঁচো একসাথে জিভ কাটলাম। পেঁচোর এই একটা দোষ – দুর্ধর্ষ সব সমস্যার সমাধান করে, কিছু ছোট্ট ব্যাপারগুলি নজর এড়িয়ে যায়। কুহেলির অবশ্য মজাই মজা – ফিকফিক করে হাসছে।
"বেশ, এবার একটু ব্রেক আর ব্রেকফাস্ট। খেয়েদেয়ে চলো আমরা এক রাউন্ড বেরিয়ে আসি। তারপর পরের সমাধানটা ভেবে দেখো।"
অগত্যা ব্যাপারটা তখনকার মতো মুলতুবি রইল। তবে ইতিমধ্যে আমরা এক ঝলকে ঐ ধাতুর ফলকটা দেখে নিয়েছি। বোধহয় অনেক দিনের পুরনো, সম্প্রতি হয়তো পালিশ করে একটু চকচকে করা হয়েছে। তার মধ্যে বড়ো বড়ো অক্ষরে খোদাই করা – ১৯৩১। আরও কিছু যদি লেখা থেকেও থাকে, তা আর পড়া যাচ্ছে না।
চটপট ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গাড়িতে উঠলাম। পেঁচোকে দেখে কিন্তু মনে হল, ওর মগজ বসে নেই। বোধহয় ঐ ১৯৩১ নিয়েই আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে। ধাতুর ফলকটাও পকেটে পুরে নিয়েছে, মাঝে মাঝে দেখছে।

"আমরা কোথায় যাচ্ছি, বলো তো?"
বললাম, "কী জানি, কাকা। খড়্গপুর তো রেল শহর, তাছাড়া আর –"
"আই-আই-টি। আমরা তো মোটামুটি সেই দিকেই যাচ্ছি?" পেঁচো আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বলল।
"ঠিক বলেছ জ্যোতির্ময়। তোমরা আগে এখানে এসেছ?"
আমি আর কুহেলি জানালাম যে আসিনি। পেঁচো বলল, "আমি ম্যাথমেটিকস ডিপার্টমেন্টে সুজন সেনগুপ্তর কাছে মাঝে মাঝে আসি।"
"ওঃ, ওকে তো আমিও চিনি। দেখি যদি ফোনে ধরা যায় তবে ওটাই হবে আমাদের ফার্স্ট স্টপ।"
প্রফেসর সেনগুপ্ত পেঁচোকে ও কাকাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। কাকা সংক্ষেপে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
"কী হে জ্যোতির্ময়, তুমি তখন থেকে মন দিয়ে কী দেখছ?"
পেঁচো ঝট করে ধাতুর ফলকটা লুকোতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই প্রফেসর সেনগুপ্ত তাঁর হাত থেকে ওটা নিয়ে ভালোভাবে দেখতে লাগলেন। তারপর বললেন, "ইন্টারেস্টিং! মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলের জিনিস। কোথায় পেলে?"
"বলতে পারেন, কুড়িয়েই পেয়েছি। তাই দেখছি।" বলে পেঁচো জিনিসটা তাঁর হাত থেকে ওটা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে চালান করল।
ভদ্রলোক এবার ভালো করে ঘুরেফিরে ডিপার্টমেন্ট দেখালেন, কম্পিউটার সাইন্স বিভাগেও নিয়ে গেলেন। তারপর একটু ক্যান্টিনে বসে অবশেষে বিদায় জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা