"এবার আমরা এই ক্যাম্পাসের মধ্যেই আর একটা জায়গায় যাব, যা বোধহয় জ্যোতির্ময়ও দেখেনি।" কাকা ঘড়ি দেখে বললেন, "এতক্ষণে খুলে গেছে।"
তাঁর পেছন পেছন আমরা একটা বাড়ির সামনে হাজির হলাম, যার সামনে বড়ো করে লেখা 'নেহরু মিউজিয়াম অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনলজি'। "ভালো করে দেখে রাখো।" বললেন কাকা, "এই জায়গাটার একটা ইতিহাস আছে।"
আমরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইছি, পেঁচো ভুরু কুঁচকে কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন বোঝার চেষ্টা করছে। কাকা বলতে শুরু করলেন:
"এখন যেখানে দাঁড়িয়ে এই আই-আই-টি, এককালে সেখানে ছিল হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প বা হিজলি জেল। ব্রিটিশ আমলে স্বধীনতা সংগ্রামীদের এখানে রাখা হতো। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেল পুলিশ গুলি চালায়। তাতে মারা যান বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও সন্তোষ মিত্র। এই জেল হত্যাকাণ্ডে দেশে তুমুল বিক্ষোভ দেখা যায়। নেতাজী আর রবীন্দ্রনাথও প্রতিবাদে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন।"
"ক্-কত সালে জেল হত্যাকাণ্ডটা হয়েছিল, বললেন?" পেঁচোর স্বরে উত্তেজনা।
"১৯৩১। তা, কালক্রমে এই ডিটেনশন ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার এখানে সেনা ছাউনি বসায়। তারপর তো যুদ্ধও শেষ হয়। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার দেশে বিশ্বমানের কারিগরি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী ১৯৫১ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকললজি বা আই-আই-টি স্থাপিত হয় এই হিজলিতে। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানেই ছিল হিজলি জেল।"
"এই বাড়িটাই সেই জেলখানা? আর এই মিউজিয়ামে সেসব ইতিহাস দেখানো হয়েছে?" কুহেলির স্বরে উত্তেজনা।
"হ্যাঁ, এখানেই ছিল সেই জেল। কিন্তু তার অনেক পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। আর এই মিউজিয়ামে শুধু হিজলি জেলের নয়, আই-আই-টি'র ইতিহাসও দেখানো হয়েছে। শুনেছি, সন্ধ্যায় একটা সাউন্ড অ্যান্ড লাইট প্রোগ্রামে সেসব দেখানো হবে।"
তারপর কাকাবাবু যত্ন করে ওদের সব ঘুরে ঘুরে দেখালেন। সবাই যেন কয়েক মুহূর্ত ইতিহাসে ডুবে গেলাম। তবে বুঝতে পারছিলাম, পেঁচো তার মধ্যেও বর্তমান, অর্থাৎ ধাতুফলক সমস্যাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি।
"চলো, এবার বাড়ি ফেরা যাক।"
"আচ্ছা মেজকা, আমরা নিশ্চয়ই বাইরে খেয়ে যাব?" কুহেলির জিজ্ঞাসা।
"উঁহু! সফিকুলের কাছে চাবি থাকে। ওকে বলা আছে, ইতিমধ্যে রান্নাবান্না করে হয়তো টেবিলও সাজিয়ে রেখেছে।"
চলতে চলতে আমরা এক জনহীন জায়গা দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি তিনটে গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের গাড়ি থামাতে বলছে। কাকার মুখে চিন্তার ছাপ, তবে গাড়ি দাঁড় করাতেই হল।
"কী চাই, তোমাদের?"
"আপনাদের গাড়ি সার্চ করে দেখতে চাই। খবর আছে, একজন বেইমান এতে করে পালাচ্ছে। আপনারা সবাই নেমে আসুন, আমরা দেখব।"
"আমাদের গাড়িতে আমরাই, কোনও বাইরের লোক নেই।" রাগতভাবে বললেন কাকা, "আর যদি থাকেও, তবে তাকে তোমাদের মতো গুণ্ডার হাতে ছেড়ে দেব কেন?"
"দেবেন এই জন্য।" ওদের একজন সাথে সাথে জানালা দিয়ে একটা পিস্তল কুহেলির কপালে ঠেকাল। দেখা গেল অন্য দুজনের হাতেও ভোজালি, রড প্রভৃতি। তারপর আদেশ হল, "এবার একে একে নেমে আসুন। আমরা আপনাদের পরীক্ষা করে তারপর গাড়ি সার্চ করব।"
কাকার মুখ রাগে, অপমানে লাল। তবে নিরুপায় আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। পেঁচোও সহযোগিতা করছে, সম্ভবত কুহেলির বিপদের কথা ভেবে। কিন্তু ওর চোখ দেখলাম ঘুরছে। ভালো লক্ষণ নয়!
ছেলেগুলো আমার ও পেঁচোর আইডেন্টিটি দেখল। তারপর গাড়ির ভেতরে ঝুঁকে দেখল কেউ গুঁড়ি মেরে বসে আছে কিনা। সীটের তলাও বাদ গেল না। শেষে একজন বলল, "রং ইনফরমেশন, বস! তাহলে এদের ছেড়ে দিই?"
যে লোকটা কুহেলির কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছিল, সে অনিশ্চিতভাবে বলল, "ছেড়ে দিবি? মানে – ক্যাঁক!"
শেষ কথাটা অবশ্য অনিচ্ছাকৃত। কুহেলি শাড়ি পড়া জড়োসড়ো বঙ্গবধূ নয়। লোকটার মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে প্যান্ট পরা হাঁটু দিয়ে তার পেটে বসিয়েছে এক মোক্ষম লাথি। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল 'বস', তার হাত থেকে পিস্তল ছিটকে গেল। আর সেই সুযোগে পেঁচো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের দঙ্গলের ওপর। তারপর সেই বহু পরিচিত 'পেঁচোর পাঁচন'। কান টেনে, কাতুকুতু দিয়ে, খিমচে, কামড়ে, এভাবে 'নন-কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার'-এর হদ্দমুদ্দ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক তিনটেকে লাট করে দিল।
"এদের এবার পুলিশে দেওয়া যাক, কী বলেন কাকা?"
"না না", লোকগুলো হাত জোড় করছে, "মাফ করুন সান্যাল কাকু, সত্যিই রং ইনফরমেশন। আপনাকে তো অনেকদিন চিনি, ভরে ভরে আমাদের দিয়েছেন। কিন্তু জানা ছিল না যে আপনি সঙ্গে বাউন্সার নিয়ে ঘুরছেন, তাও মেয়ে বাউন্সার। সঙ্গে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া একটা পান্তোভূত, যে ক্যালানোর কোনও স্ট্যান্ডার্ড নিয়মকানুন মানে না। না কাকু, নাককান মলছি, এবারের মতো ছেড়ে দিন। কথা দিচ্ছি, আমাদের দলের কেউ আর আপনাদের ত্রিসীমানা মাড়াবে না।"
"চলো।" তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ করে কাকা আমাদের গাড়িতে উঠতে ইঙ্গিত করলেন।