অগত্যা মধ্যাহ্নভোজের পর আবার পেঁচোদের ঘরে আমাদের মিটিং। পেঁচো চিন্তিত মুখে বলছে, "মিউজিয়ামে আমরা কী কী দেখেছি? পর পর ভেবে যা, তার কোনটা কাকার ক্লু।"
কুহেলি বলল, "মেজকাকে এতক্ষণে আমিও একটু-আধটু বুঝতে পারছি। ঐ যে বললেন না ঘরে গিয়ে বসে ভাবো – অর্থাৎ এই ক্লু-র অর্ধেকটা মিউজিয়ামে, বাকিটা এই ঘরেই আছে।"
ঘরে টেবিল, চেয়ার, ফুলদানি, খাট, আলমারি – কোনওটাই তো মনে হয় না 'ক্লু'। এবার দেওয়ালের দিকে আমাদের নজর গেল। সেখানে ক্যালেন্ডার, বিভিন্ন আর্টের জিনিস, ফটো – আমরা পরপর দেখতে লাগলাম। তেমন বৈশিষ্ট্য বা মিউজিয়ামের সাথে যোগসূত্র থাকতে পারে এমন কিছু কিন্তু চোখে পড়ল না। হঠাৎ পেঁচো বলল, "ফটোগুলোও একবার নজর করে দ্যাখ।"
দেখলাম, তবে সেখানেও বিশেষ কিছু পেলাম না। বাড়ির বিভিন্ন ঘরে দেখেছি এই পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষদের ছবি টাঙানো আছে। এই ঘরে আগের যুগের বিভিন্ন বিখ্যাত ভারতীয় মনীষীর ছবি, প্রত্যেকটির তলায় একটি উপযুক্ত বাণী সুন্দর অক্ষরে লেখা। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, সি ভি রমন, জহরলাল নেহরু, হোমি ভাবা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়...
"এদের মধ্যে একজন 'অড-ম্যান-আউট', বেখাপ্পা। কে বল তো? পেটে আসছে, মুখে আসছে না –"
পেঁচোর কথায় আমরা গভীরভাবে ফটোগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। একটু পরে আমি অনিশ্চিত ভঙ্গীতে বললাম, "জহরলাল নেহরু?"
"ইয়ে-এ-এ –" পেঁচো মহোল্লাসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল, "তুই একবারেই বুলস্-আই হিট করেছিস।" তারপর একটু সন্ধিগ্ধ ভঙ্গীতে জিগ্যেস করল, "কিন্তু ধরলি কীভাবে?"
"সোজা।" আমি সগর্বে বললাম, "আর সবাই তো বাঙালি, নেহরু ছাড়া।"
"এইজন্যেই তোকে গবু বলি।" পেঁচো সস্নেহে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, "তুই মাঝে মাঝে ভুল করে ঠিক উত্তরটা দিয়ে দিস। ওরে গবুচন্দ্র, হোমি ভাবাও তো অবাঙালি। সি ভি রমনও তাই, যদিও তিনি মধ্যে কলকাতাবাসীই হয়ে গিয়েছিলেন।"
তাই তো – আমি ফিউজ হয়ে গেলাম। পেঁচো আমার দিকে ফিরে বলল, "তবে ঘাবড়াস না, তোর উত্তরটা ঠিক। আমারও এমন একটা কিছু মনে হচ্ছিল, কিন্তু এতক্ষণ ধরতে পারছিলাম না। লিস্টিটা ভালো করে দ্যাখ – সবাই-ই প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী। শুধু নেহরু বিখ্যাত রাষ্ট্রনেতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী।"
"তাহলে নেহরুর কথাটাই মেজকা বোঝাতে চেয়েছেন?" কুহেলি বলল।
"হ্যাঁ, ডিয়ার। তুমি ঠিক ধরেছিলে – আদ্ধেক ক্লু মিউজিয়ামে আর আদ্ধেকটা এখানে। নেহরু বা তাঁর এই ফটোটাই কাকার পরবর্তী ক্লু।"
"কিন্তু মিউজিয়ামের সঙ্গে নেহরুর কী সম্পর্ক?"
"সম্পর্ক নামে – মিউজিয়ামটাই তো নেহরুর নামে!"
"তাহলে – এবার?"
"চল, কাকাকে গিয়ে বলি যে তাঁর চতুর্থ ক্লুও আমরা পেয়ে গেছি, এবার পঞ্চমটা।"
বলতে হল না। আমাদের সম্মিলিত হর্ষধ্বনি শুনে কাকা সহাস্যে ঘরে উঁকি মারলেন আর আমাদের আলোচনা শুনে স্মিত হেসে বললেন, "বাঃ। তোমরা নেহরুজী অবধিও পৌঁছে গেছ। তাহলে শেষ ক্লুটাও এবার বের করে ফেল। আর সেটা সমাধান করতে পারলেই –"
"করছি।" বলে পেঁচো নেহরুর ফটোটা দেওয়াল থেকে টেনে নামাল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখছি তার পেছনে কোনও গুপ্ত কুঠুরি আছে কিনা। না, তেমন কিছু নেই। কিন্তু পেঁচো ততক্ষণে ছবিটা উল্টে ফেলেছে আর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, তার পেছনে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছবি ও বাণী, "আমরা যথা হইতে আসি তথায় ফিরিয়া যাই।"
"এটাই ভাবছিলাম – সে যুগের বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনেকেই আছেন, কিন্তু জগদীশচন্দ্র নেই কেন?" পেঁচো বলল, "এখন বুঝলাম, তিনি ছিলেন। কিন্তু আমাদের ক্লু দেওয়ার জন্য তার উল্টোদিকে নেহরুর ফটো লাগিয়ে কাকা ফ্রেমটাকে উল্টে রেখেছিলেন। কিন্তু তার থেকেই বা কী দাঁড়াল?"
"একটু ভাবো, এটুকুও পেয়ে যাবে। আর এই গাঁটটা পেরোতে পারলেই তোমাদের –"
"মোক্ষলাভ?"
পেঁচোর কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠে কাকাবাবু বললেন, "তা যা বলেছ। তাহলে বোধহয় কাল বিকেলের মধ্যে কাজটা শেষ করে তোমরা শিডিউল অনুযায়ী জনশতাব্দী ধরতে পারবে।"
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা অবধিও শেষ ক্লু-টার পর্দা ফাঁস হল না। আমি আর কুহেলি একটু ভেবেই খেই হারিয়ে ফেলেছি। পেঁচো কিন্তু লড়েই যাচ্ছে।
"আচ্ছা, সূত্রটা কি জগদীশচন্দ্রের ছবিতে, না নামে, না বাণীতে?" ও বলল।
বললাম, "বাণীটা তো ওনার একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া, যা আমাদের স্কুলপাঠ্য ছিল। সেখানে তিনি জলচক্র বা ওয়াটার সাইকল বোঝাবার পর দেখিয়েছিলেন যে জল মহাদেবের জটা অর্থাৎ হিমবাহ থেকে নদী বেয়ে সমুদ্রে মেশে। তারপর আবার বাস্প ও মেঘ হয়ে ঐ পাহাড়ের চূড়াতেই ফিরে যায়।"
"এর একটা গভীর মানেও আছে।" কুহেলি বলল, "আমরা প্রাণীরাও তেমনই অচেতন জগত থেকে জীব হয়ে জন্ম নিয়ে চেতনার জগতে আসি। তারপর আবার মৃত্যুর সাথে সাথে ঐ অচেতনের জগতেই ফিরে যাই।"
তাহলে কি এই গূঢ় অর্থটাই সূত্র? নাকি অন্য কিছু – ঐ ছবিতে বা ছবির ভাঁজে বা তার সাথে যুক্ত কিছুতে? এই ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, রাতও। অবশ্য কাল ফেরা, তাই সবাই আজ কাকার সাথে অনেক কথাবার্তাও সারলাম। পেঁচো বারবার বলল সময় পেলে একবার তাদের বাড়িতে আসতে।
"হ্যাঁ, যাব। কিন্তু তার আগে বেশ কিছু কাজ আছে, সারতে হবে। তবে তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাই। আমি আবার একটু ব্যাক ডেটেড, হোয়াটস্অ্যাপে স্বচ্ছন্দ নই। আমাকে ইমেল আই-ডি'ই দিতে হবে।"
ই-মেল আই-ডি বিনিময় করে সবাই শুতে গেলাম। সে রাতটা আমার খুব অস্বস্তিতে কাটল। বারবার ঘুম ভেঙে গেল। একবার মনে হল পেঁচোর ঘর থেকে কে যেন নিঃশব্দে বেরোল। তাহলে কি পেঁচো মাঝরাতে অন্ধকারে ক্লু খুঁজছে? আমি আর কুহেলি ইতিমধ্যেই হাল ছেড়ে দিয়েছি, এখন পেঁচোই ভরসা। ও কি সময়মতো কিছু খুঁজে পাবে? নইলে কি বেইজ্জত হয়েই বিদায়, নাকি ফেরার দিন পিছোনো?
পরদিন সকালে অবশ্য একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। বাইরে এসে দেখি, পেঁচো মুখে গৌতম বুদ্ধের প্রশান্তি নিয়ে বসে। বলল, "তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি সেই কখন উঠেছি। কুহেলি এই উঠল, ফ্রেশ হয়ে আসছে।
ইতিমধ্যে আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে কাকা তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। পেঁচোর দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললেন, "কী হে জ্যোতির্ময়, সমাধান পেলে? নাকি ছুটি এক্সটেন্ড করবে?"
পেঁচো শান্তভাবেই বলল, "তাড়া কীসের? আগে ব্রেকফাস্টটা হয়ে যাক।"
"শিওর।" বলে কাকা ব্রেকফাস্টের আয়োজনের জন্য গেলেন। সফিকুল একটু পরে আসে। তাই ব্রেকফাস্টটা কাকা নিজেই তৈরি করেন। এই দু'দিনও তাই করেছেন, কুহেলির শত আপত্তি সত্ত্বেও তাকে কিচেনে ঢুকতে দেননি।
পেঁচো ব্রেকফাস্ট তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে, যেন কোনও তাড়া নেই। তাহলে কি ও হাল ছেড়ে দিয়েছে? নাকি – সমস্যাটার সমাধানই করে ফেলেছে? চা-টাও ধীরেসুস্থে শেষ করল। আমরা সবাই ওর দিকে তাকিয়ে।
"কাকা, চলুন আপনার ঘরে যাওয়া যাক।"
সন্ধানী দৃষ্টিতে পেঁচোর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে কাকা বললেন, "হঠাৎ? বেশ, চলো।"
ওর পেছন পেছন আমরাও কাকার ঘরে গেলাম। পেঁচো পকেট থেকে পেছন দরজার চাবিটা বের করে বলল, "এটার আর দরকার নেই, এবার যথাস্থানে রেখে দেওয়া যাক।"
"আমাকে দাও, আমি রাখছি।" কাকা বলতে না বলতেই পেঁচো গিয়ে তাঁর আলমারিটা খুলে ফেলল। তারপর লকারের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি কি এর কম্বিনেশনটা পাল্টেছেন?"
"হ্যাঁ, প্রায়ই পাল্টাই। তবে তোমরা তো পাঁচটা ধাঁধারই সমাধান করেছ, তাই নতুন কম্বিনেশনটা বলেই দিচ্ছি – ১,১,২,৩,৫ আর – আর – এই রে, শেষ সংখ্যাটা ভুলে গেলাম। ঝামেলা হল তো! সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছি।"
পেঁচো স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "শেষ রাউন্ডে একটা গুগলি দিলেন তো? কিন্তু আমার কাছে এসব স্রেফ বাপী বাড়ি যা।" বলে সে চটপট কম্বিনেশনটা সেট করল আর লকার সাথে সাথে খুলে গেল। সেখানে চাবিটা যথাস্থানে রেখে একগাল হেসে সে ওখানে রাখা আর দুটো কাগজের প্যাকেট বের করে এনে কাকার হাতে দিয়ে বলল, "সব হেঁয়ালিই ফাঁস। বলুন এবার কী করতে হবে আর আপনার গিফটই বা কোথায়।"
পেঁচোর পিঠ চাপড়ে কাকা বললেন, "বাহাদুর ছেলে! জানি, এই হেঁয়ালিগুলির রহস্যভেদ তোমরা ঠিক করতে পারবে। শেষ সূত্রটাও ঠিকই ধরেছ – যথা হইতে আসি তথায় ফিরিয়া যাই মানে –"
"যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, অর্থাৎ আপনার লকার, সেখানেই যাত্রা শেষ। এবার আপনার ওই 'ভুলে যাওয়া' সংখ্যাটা – প্রথম দুটো ছেড়ে অন্য সব সংখ্যাগুলি হচ্ছে আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। সুতরাং আপনার ঐ ভুলে যাওয়া শেষ সংখ্যাটা তিন আর পাঁচের যোগফল আট। একে অঙ্কশাস্ত্রে বলে 'ফিবোনাক্কি সিরিজ', একজন অঙ্ক গুলে খাওয়া মানুষের কাছে জলভাত। কিন্তু এতক্ষণে আমি সব ব্যাপারটায় যেন একটা অঙ্ক-অঙ্ক গন্ধ পাচ্ছি?"
"তোমার ঘ্রাণশক্তি সত্যিই প্রখর। গিফটটাও তাহলে আর খোঁজাখুজি করতে হবে না। ঐ দুটো প্যাকেটেই তা রয়েছে – একটা তোমার, একটা বুড়ির। এ ছাড়া এত মগজমারির পারিশ্রমিক হিসেবে তোমাদের প্রত্যেকের ই-মেল আইডি'তে আমি কাল রাতে দশ হাজার টাকার ই-গিফট কুপন পাঠিয়ে দিয়েছি। পছন্দমতো জিনিস কিনে নিও।"
কাগজের প্যাকেট দুটো খুলে দেখে পেঁচো একটু অবাক হয়ে বলল, "কুহেলির গিফটটা তো দেখছি কিছু দলিল-দস্তাবেজ। আর আমারটায় কীসব অঙ্ক কষা।"