সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

এ দিকে সবার মনেই স্ফূর্তি। নদীর পাশেই,পার থেকে সামান্য ওপরে স্পট ঠিক হয়ে ছিল। সঙ্গে আনা পাটি,শতরঞ্চি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথার ওপরে আম গাছের ছত্র ছায়া ছিল। এখানটায় পরপর বেশ কতগুলি আম গাছ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের যে গরমটুকু গায়ে লাগছিল,গরম অনুভব হচ্ছিল,গাছের ছায়ায় তা আর লাগছে না,বরং ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ অনুভব করা যাচ্ছিল।

রান্নার সরঞ্জাম সঙ্গেই আনা হয়েছে--গ্যাস ওভেন,সিলিন্ডার থেকে নিয়ে বাসনকোসন—সবজি,মাছ,মাংস সব।

টিফিন নেবার পরে সবাই এক জাগায় বসে গল্প শুরু হল। আধ ঘণ্টা পরে রান্না বসবে। দেড় দু ঘণ্টায় রান্না শেষ হবে। ঠিক হল পিকনিকের রান্নায় গিন্নীরা হাত লাগাবেন না। কারণ সারা বছর ঘরের রান্না গিন্নীরাই করেন। তাই আজ তাঁদের বিশ্রাম। ঘরের কর্তারা আজ রান্না করবেন। পরিবেশন না হয় গিন্নীরাই করে দেবেন। বাচ্চারা এমনি উলটো ব্যবস্থা দেখে নিজেরা হেসে আনন্দ উপভোগ করল—আজ তাদের মায়ের জাগায় বাবা রান্না করছেন!

সেই মত রান্নাবান্না শুরু হল। মাছ,মাংস,ডাল,বেগুন ভাজা—এমন কি ডিমের ঝোলের ব্যবস্থাও হল।
জলের ব্যবস্থা ঘর থেকেই করে নেওয়া হয়ে ছিল। রান্নায় নদীর জল ব্যবহার করা যাবে এমতই কথা ছিল।

রান্না নিয়ে তিন ঘরের কর্তা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মণ্ডল বাড়ির দাদু,দিদা দুজনে একদিকে পান চিবোতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। গিন্নিরা ঘরের নানা গল্পে মেতে উঠলেন--বেশির ভাগই বাচ্চাকাচ্চার গল্প,রান্না খাওয়ার গল্প,শাড়ি গয়নার গল্প।
অলিভিয়া,সুমন ছোট,ওরা দাদা-দিদিদের দৌড়াদৌড়ি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা দেখতে মেতে গেল।

বেলা দুটো বেজে গেল। খাওয়া দাওয়ার পাট শুরু হল,আবার এক সময় শেষও হয়ে গেল।
সবার এবার অল্প সময় বিশ্রাম নেবার সময়। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বার্তায়,গল্প গুজবে মত্ত। তারই এক ফাঁকে কদম ফিস ফিস করে বলে উঠলো,‘যাবি,মিন্টু,ওই নৌকাগুলি দেখে আসতে?’
মিন্টু ভাবল ঠিক আছে--একটু ঘুরে আসি,ও বলল,‘ঠিক আছে চল,নৌকা দেখে,কাছ থেকে নদী দেখে,আর যদি জেলেরা মাছ ধরে তা দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।’
মিন্টু জুনির কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে নদী দেখতে যাবার প্রস্তাব পেশ করল।
জুনির নদীর কথা খুব মনে পড়ছিল। ছবি আঁকা নদী ও দেখেছে--বাস্তবে কলকল,ছলছল বয়ে যাওয়া নদী কাছ থেকে যদি না দেখা গেল তবে কি ভালো লাগে! ও চার পাশে তাকিয়ে দেখল--সবাই ব্যস্ত, মা,বাবা,কাকা,কাকীরা—এমন কি দিদা,দিদুন সবাই। ও বলল,‘চল তাড়াতাড়ি নদী দেখে ফিরে আসবো।’ 

ওরা প্রায় ছুটতে ছুটতে নদীর পারে পৌঁছে গেল। সুন্দর নদী। কল কল রবে বয়ে চলেছে। ঠাণ্ডা হওয়া বইছিল চারি দিকে। আর ওই পারে দু জন মাছ ধরছে না ?
কদম প্রায় চীৎকার করে উঠলো,‘ওই দেখ জেলেরা মাছ ধরছে!’
--‘আরে আরে,ওরা যদি এ পারে থাকত ভালো হত’,মিন্টু বলে উঠলো।
কদম বলা নেই কওয়া নেই তড়তড় করে জলের ধারে নেমে গেল।
জুনি বলে উঠলো,‘এই,জলের কাছে যাস না!’
মিন্টু নৌকো দেখছিল। একটা ভাঙ্গা,আর একটা সুন্দর রংচং করা!
নদীর যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে ছিল মোটামুটি সে জাগাটা পরিষ্কার ঘাটের মত মনে হচ্ছিল। গাছপালা,জঙ্গল সেখানে কিছুই ছিল না,কিছু বালি কাদা নিয়ে নদীর কিনারা। পার ধরে সামান্য দূরেই ঝোপঝাড়,হালকা জঙ্গল,ছোট ছোট,মাঝারি গাছপালায় নদীর পার ভরে আছে।

মিন্টু আর জুনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নৌকা দেখছিল। ওদের চোখে পড়ল,জেলেরা মাছ ধরতে ধরতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। হঠাৎ মিন্টুর মনে হল,আরে,‘কদম কোথায় ?’
জুনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে উঠলো,‘ওই তো কদম,আরে ও দেখি জলে নেমে গেছে!’
জুনি আর মিন্টু ছুটে গেল কদমের কাছে। মিন্টু বলল,‘কদম, শীগগির তুই জল ছেড়ে ওপরে ওঠ,না হলে এক্ষণ আমি কাকুকে ডাকছি।’
--‘এই দেখ,দেখ,কত মাছ রে!’ বলে কদম দু হাতে মাছ ধরার চেষ্টা করল,‘ওই দেখ বড় একটা মাছ,ঠিক আমার হাতের কাছে!’ কথা কটি বলেই কদম এক লাফ দিয়ে বড় মাছ ধরতে গেল। ব্যাস,চোখের নিমেষে ঘটে গেল অঘটন,নদীর গভীর জাগায় ওর পা পড়ে গেলো। হঠাৎ ওর মনে হল ওর পা যেন মাটিতে ঠেকল না,নীচে গভীরতা অনেক বেশী। সোজা ও ডুব জলে পড়ে গেল। আর ক্রমশ ডুবে যেতে লাগলো।
মিন্টু আর জুনির সামনে কদম ডুবে যাচ্ছিল। ওরা দিশাহারা হয়ে,‘কদম,কদম’,বলে চীৎকার করতে থাকলো।

বীর বালক
ভীত সন্ত্রস্ত জুনি চীৎকার দিয়ে ডেকে উঠল,‘ক-দ-ম-----বাবা-কাকু’--এমনি এলোমেলো ডাকতে ডাকতে জুনি ছুটে গেল বাবা,মা ওদের খবর দিতে।

এদিকে মিন্টু দেখল,কদম ডুবে গেল,ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। মুহূর্ত পরে হঠাৎ ওর মাথাটা ভেসে উঠলো,মিন্টু চীৎকার করে,‘কদম’,বলে ডেকে উঠলো। পরক্ষণেই কদম আবার জলের নীচে ডুবে গেলো। নদীর জলের স্রোত ওকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মিন্টু ছুটতে থাকলো পার ধরে--নদীর স্রোতের অনুকূলে। যদি আবার কদম ভেসে ওঠে,ভেবে ও নদীর পার ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার যদি কদমের মাথা ভেসে ওঠে,ও যদি পার থেকে ওর মাথা ধরে ফেলতে পারে! এর আগে মাত্র দু হাত দুরেই ওর মাথা ভেসে উঠে ছিল। এমনি সময় মিন্টু দেখতে পেল ঠিক ওর পাশেই কদমের মাথা আবার ভেসে উঠলো। তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে দিল সে,আর খপ করে ওর চুলের মুঠি ধরে নিলো। কিন্তু ওকেও তো জলের স্রোত টানছিল। চীৎকার করল মিন্টু,‘বাঁচাও! বাঁচাও!!’বলে।

এমনি সময় ও দেখল নদীর কিনারায়,ঠিক ওর পাশটাতেই পাতলা,নেড়া মত একটা গাছ। মুহূর্ত দেরী না করে ও গাছটাকে এক হাতে কষে ধরে নিলো। ওর এক হাতে কদমের চুলের মুঠি,অন্য হাতে ধরে থাকা নদীর পারের সরু গাছটা!

মিন্টুকে একদিকে কদমের শরীর আর নদীর জলস্রোত ভীষণ ভাবে টানছিল। অন্য দিকে হাতের আঁকড়ে ধরা গাছটা ছেড়ে যাবে,ছেড়ে যাবে করছিল। ওর মুখ থেকে বারবার ওর অজান্তেই চীৎকার বেরিয়ে আসছিল,‘বাঁচাও,বাঁচাও,বাঁচাও...’আর কয়েক মুহূর্ত।

এদিকে সবাই ছুটে এসে গেল। মিন্টুর বাবা মিন্টুর হাত চেপে ধরলেন। মণ্ডল বাবু তার ছেলের চুলের গোছা টেনে ধরলেন। এ দিকে সবার ভিতরে চীৎকার,চেঁচামেচি,হই চৈ চলছিল। দাস বাবু ভালো সাঁতার জানতেন। তিনি জলে নেমে কদমকে টেনে তুললেন।

কদম চুপচাপ পড়ে ছিল,বোধ হয় ভয়ে ওর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। সামান্য জল ওর পেটে গিয়ে ছিল। চোখ দুটি লাল হয়ে ছিল। স্থির হয়ে ছিল ও। একটু পরেই ও নড়েচড়ে উঠলো।

আজ মিন্টুর সাহসিকতার জন্যই কদম বেঁচে গেল। মণ্ডল মশাই মিন্টুর মাথায় হাত রেখে বড় করুণ সুরে বললেন,‘বাবা! তোমার জন্যেই আমার ছেলে আজ বেঁচে গেল।’

কদমের মা কিছু বলার মত অবস্থায় ছিলেন না। কান্নায় দু চোখ ছেপে তাঁর জল এসে গিয়ে ছিল। কদমের দাদু,দিদা মিন্টুর পীঠ চাপড়ে মাথায় হাত রেখে অনেক আশীর্বাদ করলেন।

মিন্টু সত্যি সাহসের পরিচয় দিয়েছিল। আজ কদমকে ও বাঁচিয়েছে। নিজের জীবনের সংশয়ের কথা চিন্তা না করে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কদমকে বাঁচাতে। এ কাজের জন্যে সাহস,সে সঙ্গে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব থাকা খুব জরুরী । এ দুটো গুনইমিন্টুর মধ্যে ছিল।

এমনি বীর,সাহসী ছেলে মেয়েরাই তো দেশের গৌরব।

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা