সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

তরুণ অরণির ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর ইনটেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের অফিসার। প্রখর বুদ্ধি আর দুরন্ত সাহসের জন্য অল্প বয়েসেই তার খুব নাম। তার কম্যাণ্ডো ট্রেনিংও নেওয়া আছে। বন্ধুর কাছে সংক্ষেপে ঘটনা শুনেই সে জরুরী তলব দিয়ে চটপট একটা অ্যাকশন টিম জড়ো করে ফেলল। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পলাতক প্রাণীটির অগ্রগতি প্রতিহত করা। নইলে সে যেখানেই যাবে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে সবার সর্বনাশ করে ছাড়বে। তবে ব্যাপারটা স্রেফ কয়েকটি নির্দিষ্ট বিভাগকে ও কয়েকজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই জানানো হ’ল, যাতে জনসাধারণ আতঙ্কে বেসামাল না হয়ে পড়ে।

টিমটির প্রাথমিক চেষ্টা অবশ্যই হবে কিম্ভুতকে পাকড়াও করা। কিন্তু যদি দেখা যায় অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠছে, তারা নির্দ্বিধায় প্রাণীটিকে ধ্বংস করবে। পুলিশ স্টেশন ও রাত পাহারাদের কাছে খবর পাঠানো হ’ল – অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেলে টিমটিকে তারা যেন তক্ষুণি জানায়। কিন্তু খবরদার – নিজেরা যেন আগ বাড়িয়ে কিছু করতে না যায়।

সাধারণ আগেয়াস্ত্রে কাজ নাও হতে পারে অনুমান করে তরুণ একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা ছকে রেখেছিল। তাদের প্রথম চেষ্টা হবে, অতর্কিতে কড়া ঘুমপাড়ানী বন্দুকের গুলিতে কিম্ভুতকে বেহুঁশ করে ফেলা। সেটা সম্ভব হলে তখন প্রাণীটিকে শক্তপোক্ত ইস্পাতের জালে বেঁধে ঘুম ভেঙে ওঠার আগেই কলকাতা চিড়িয়াখানার এক বিশেষ মজবুত খাঁচায় এনে বন্দি করে রাখা হবে।

তাদের অবশ্য সন্দেহ ছিল যে ব্যাপারটা হয়ত অত সহজে মিটবে না। এই অদ্ভুত জন্তুটির কাছ থেকে আরো কত চমক অপেক্ষা করছে, কে জানে! পরিস্থিতি যদি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে থাকে তাহলে কাজে লাগাবার জন্য তারা কয়েকটি মিলিটারি গ্রেনেড সঙ্গে নিল। সব দিক বিবেচনা করে টিমে মিলিটারির কয়েকজন পোড় খাওয়া যোদ্ধাকেও নেওয়া হ’ল। ব্যস, প্রস্তুতি শেষ – এবার দুরু দুরু বুকে খবরের অপেক্ষায় থাকা।

প্রথম খবর এল বাংলা-বিহার সীমান্তবর্তী এক টহলদার দলের কাছ থেকে। গভীর রাতে ওই এলাকার বারশোল গ্রামের অধিবাসীরা টের পায় যে গ্রামের খেতে কোন একটা জানোয়ার ঢুকেছে। আশেপাশের জঙ্গল থেকে দলছুট কোন হাতি এসেছে ভেবে তারা মশাল আর পেটানোর টিন নিয়ে সেখানে জড়ো হয়। কিন্তু যখন জন্তুটা তার কদাকার মাথাটা বের করল, দেখেই গ্রামবাসীদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়! এমন জিনিস তারা কেউ বাপের জম্মে দেখেনি। বড়জোর রূপকথার দত্যিদানোর সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে। মশাল-টিন ফেলে তারা পাঁই-পাঁই করে পিটটান দিল। যে দু-একজন দুঃসাহসীর পেছন ফিরে তাকাবার হিম্মত হয়েছিল তারা দেখল যে জন্তুটা তাদের ফেলে আসা মশাল চাটছে!

উপ্‌স – প্রাণীটা চার ঘণ্টায় কয়েকশো কিলোমিটার পথ চলে এসেছে! অ্যাকশন টিমটি তক্ষুণি দুটো মিলিটারি জিপে করে বারশোলের দিকে রওনা দিল।

যেতে যেতে তারা বুঝতে পারল যে তাদের জিপ দৈবাৎ কিম্ভুতের চলার পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। তখনও ভোর হয়নি। কিন্তু এখানে-সেখানে কিছু ছোটবড়ো উত্তেজিত জটলা চোখে পড়ল। কখনও তা কোন কুকুর বা গরুর প্রাণহীন, শীতল দেহ ঘিরে। আবার এক জায়গায় তাদের চোখে পড়ল এক ট্রাক ড্রাইভারের মৃতদেহ – তার চোখ যেন ভয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে।

ভাগ্য যে কেন তাদের প্রাণীটির চলার পথেই নিয়ে এসেছে, অরণি তা একটু পরেই বুঝতে পারল। যে বড় সড়ক ধরে তারা চলেছে, তার পাশ বরাবর চলে গেছে উচ্চশক্তির বৈদ্যুতিক তার। শক্তিভুক কিম্ভুত স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে তাকেই অনুসরণ করেছে, যাতে দরকারমতো সেখান থেকে তার শক্তির রসদ জোগাড় করে নেওয়া যায়! আর সে যে সত্যিই নিয়মিত ওখান থেকে নিজেকে 'রি-চার্জ' করে নিয়েছে, তার প্রমাণও মিলল। মাঝে মাঝেই তাদের চোখে পড়ল ওপড়ানো বৈদ্যুতিক খুঁটি অথবা ছেঁড়া তার। এমনকি অরণি ভালোভাবে পরীক্ষা করে তার আশেপাশে কিছু জান্তব কাঁটাও খুঁজে পেল, যার অজস্র নমুনা এখনও বাড়িতে কিম্ভুতের খাঁচায় ছড়িয়ে আছে।

বারশোলে পৌঁছে তারা বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখতে পেল। মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আতঙ্ক। জন্তুটি কাউকে ধরতে পারেনি, তবে তার শীতল আলিঙ্গনে কিছু গবাদি পশু প্রাণ হারিয়েছে। কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটিও উপড়ে পড়ে আছে। কিন্তু কিম্ভুত আর সেখানে নেই। গ্রামবাসীদের কথা বিশ্বাস করলে, সে পশ্চিমের দিকে চলে গেছে।

কিম্ভুতের চলার বেগ তাদের চিন্তায় ফেলছিল। অরণির ধারণা – প্রাণীটি তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে তো বটেই, তার সাথে এক একটা উড়ুক্কু লাফে অনায়াসে বিশ-ত্রিশ ফুট অতিক্রম করে যায়। ওয়্যারলেসে চটপট বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করে তারা কয়েকজনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করল। বাকিরা ঐ জিপে করেই তাদের অনুসরণ করবে।

হাই ভোল্টেজ তার কোথা দিয়ে গেছে হিসেব করে তারা মধ্যপ্রদেশের পাটলি বলে এক ছোট্ট শহরে কিম্ভুতের মুখোমুখি হবার প্ল্যান করল। সেই উদ্দেশ্যে তরুণ, অরণি ও কয়েকজন সাহসী কম্যাণ্ডো হেলিকপ্টারে চড়ে বসল। আকাশ থেকে নজরদারির চেষ্টাও যে তারা করেনি, তা নয়। তবে ঘন জঙ্গলে প্রায়ই তাদের দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিল।

পাটলিতে তারা বড় সড়কের পাশে দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল। পেছন পেছন আসা জিপটির থেকে ওয়্যারলেস মেসেজ পেয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছিল যে কিম্ভুত এই পথেই আসছে। তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’ল না।

তরুণ পূবদিকে বাইনোকুলার ফোকাস করে রেখেছিল। হঠাৎ সে ফিসফিসিয়ে হুঁশিয়ারি দিল। অরণি তাকিয়ে দেখল, দূরে গাছপালার ঝোপের মধ্যে এক অস্পষ্ট আলোড়ন। একটু পরেই সেখান থেকে অরণির ভয়াবহ পোষ্যটি লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে বেরিয়ে এল। কড়া ঘুমের ওষুধ ছোঁড়ার বন্দুক তৈরিই ছিলো, ট্রিগার টিপে দেওয়া হ’ল। ওরা নিশ্চিত যে কিম্ভুত ব্যাপারটা বুঝবার কোন সুযোগই পায়নি। কিন্তু তার কাছাকাছি পৌঁছবার পর বুলেটের গতি নিজের থেকেই কমে এল আর শেষ অবধি সেটা আলতোভাবে কিম্ভুতের শরীরে লাগল।

প্রাণীটিকে সতর্ক করে দেবার পক্ষে অবশ্য সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে তার শান্তিবিঘ্নকারীদের দিকে ধেয়ে এল – সম্ভবতঃ আন্তরিক আলিঙ্গনে তাদের বেঁধে ফেলার সদুদ্দেশ্যে। তরুণ অবশ্য তার বন্ধুত্বপূর্ণ আলিঙ্গনে ধরা দিতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলো না। তার ইশারায় কম্যাণ্ডোদের একে-৪৭ থেকে ছুটে গেলো ঝাঁক ঝাঁক গুলি। একটা হাতিকে শুইয়ে দিতেও তা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু প্রাণীটির চারপাশে যেন একটা প্রকৃতিদত্ত গণ্ডি রয়েছে – তার কাছাকাছি পৌঁছবার পর বুলেটগুলো গতি হারিয়ে স্রেফ নিরীহ ঢেলার মতো তার গায়ে আছড়ে পড়তে লাগল। বুলেটের গতিশক্তি বড়জোর প্রাণীটির শক্তিক্ষুধা নিবৃত্তিতে সামান্য সাহায্য করল।

অবশ্য এটুকু খাদ্য স্রেফ আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল। কিম্ভুত পরম আগ্রহে আরো এগিয়ে আসতে লাগল। দিশেহারা তরুণ একটা মিলিটারি গ্রেনেডের পিন খুলে চেঁচিয়ে বলল, "বাঁচতে চাও তো সব হেলিকপ্টারের দিকে দৌড়োও" বিনা দ্বিধায় দল তার আদেশ পালন করল। একটু পরই কান ফাটানো গ্রেনেড বিস্ফোরণের আওয়াজ। চারদিক ধূলোয়, ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। সেসব পরিষ্কার হলে তারা আশা করছিল প্রাণীটির ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ চোখে পড়বে। কিন্তু সভয়ে সবাই দেখল – কিম্ভুত টলছে, তবে নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে আছে। কী সাংঘাতিক – মিলিটারি গ্রেনেডের শক্তিও ব্যাটা শুষে নিচ্ছে!

"তাহলে কি ওকে থামাতে আমাদের কামান দাগতে হবে?" তরুণ হতাশ হয়ে বলল। তখন অবশ্য তারা কিম্ভুতের নাগালের বাইরে, দূর আকাশে উড়ছে।
"উঁহুঃ – এভাবে আরো শক্তি না জুগিয়ে বরং ওর দেহ থেকে শক্তি শুষে নিতে হবে।" অরণি অনেক ভেবেচিন্তে মন্তব্য করল।
"আইডিয়া!" তরুণ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল "কিন্তু কীভাবে?"
"হিমশীতল কোনো বস্তুর সাহায্যে, যেমন ধর তরল নাইট্রোজেন স্প্রে। কিম্ভুতের ওপর তরল কার্বন ডাই-অক্সাইডও কাজ করবে কিনা সন্দেহ।"
"বেশ, রায়পুরে নেমে একবার ট্রাই করা যাক। আশা করি, মাল পাওয়া যাবে।"
"হ্যাঁ – আর আশা করি চটপট পাওয়া যাবে। শক্তির আহার পেয়ে দানবটা হু-হু করে বাড়ছে। সীমা ছাড়িয়ে যাবার আগেই কিছু একটা করতে হবে।"
"কিন্তু – ওটা কী? আমি বিজ্ঞান সম্বন্ধে একেবারে অঘা নই। কিন্তু তোর এই বিচিত্র, কিম্ভুতটা যে কী জিনিস তা আমার মাথায় একটুও ঢুকছে না। তুই কিছু বুঝলি?"
"জোর করে বলতে পারি না। তবে আমার অনুমান – এটা আদিম প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝামাঝি এক আশ্চর্য প্রজাতি। হিমযুগে এর জীবকোষগুলো উপযুক্ত পরিমাণে শক্তির অভাবে পরিপূর্ণ বিকশিত হয়নি। এতদিনে এই প্রজাতি পৃথিবীর বুক থেকে লোপ পেয়েছে। কিন্তু সম্ভবতঃ কিছু 'মিউট্যান্ট' বরফ চাপা অবস্থায় নিজেদের প্রাণগুটির মধ্যে আবদ্ধ করে হাজার হাজার বছর শীতঘুমে ঘুমিয়ে ছিল। অপেক্ষা করছিল শক্তির ছোঁয়ার জন্য, যা তাদের জেগে উঠে পূর্ণ বিকশিত হতে সাহায্য করবে।"
"আর হতভাগা আমরা ঘটনাচক্রে তাদেরই একটাকে জাগিয়ে তুলেছি। কী কপাল!"তরুণ দাঁত বের করল।
"না না, হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়।" অরণি চিন্তিত মুখে বলল, "কিম্ভুতের বাড় আমাকে চিন্তায় ফেলেছে। গাছও সূর্যের আলোর থেকে সরাসরি শক্তি সংগ্রহ করে। কিন্তু তাকেও মাটির থেকে তরল বস্তুর রসদ শুষে নিতে হয়। খাঁচায় থাকাকালীন কিম্ভুত বোধহয় বাতাস থেকে আর যে খাদ্যগুলি তাকে দেওয়া হ’ত তার থেকে শক্তির সাথে সাথে তরলও শুষে নিত। কিন্তু এখন অবাধ পৃথিবীতে তার চারপাশে যেমন অফুরন্ত শক্তি, তেমন অফুরন্ত বস্তু। তাই প্রতি দিনে নয়, প্রতি ঘণ্টায় সে আরও বড় হয়ে চলেছে আর আরও বেশি বেশি শক্তি শুষে নিচ্ছে। এভাবে চললে শিগগিরই এমন একটা সময় আসবে যখন –"
"একটা 'চেন রিঅ্যাকশন' শুরু হয়ে যাবে আর কিম্ভুত সভ্যতার সমস্ত শক্তি শুষে নেবে। তার আগেই আমাদের ওকে পেড়ে ফেলতে হবে।" তরুণের হাসিটা এবার তেতো দেখায়।

শক্তিভুক

রায়পুরে তারা শেষ অবধি কাঙ্ক্ষিত তরল নাইট্রোজেন ও তার আনুষঙ্গিক সামগ্রী পেল ঠিকই। কিন্তু তার পেছনে চারটি অমূল্য ঘণ্টা ব্যয়িত হ'ল। ইতিমধ্যে তারা স্থানীয় ও জাতীয় নিউজ চ্যানেলে শুনেছে যে মধ্যপ্রদেশের কিছু এলাকার ওপর এক বিচিত্র দুর্বিপাক নেমে এসেছে। কেউ বলছে সে এক আজব জন্তু, আবার কেউ বলছে তা এক হিমেল হাওয়ার ঘুর্ণিঝড়। তবে সব নিউজ রিপোর্টাররাই শেষ অবধি যা দেখাচ্ছে তা হচ্ছে – জায়গায় জায়গায় মৃত জীবজন্তুর হিমশীতল দেহ আর খুঁটি উপড়ে বা তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাপক বিপর্যয়।

"চার ঘণ্টা সময় পেয়ে ব্যাটা বলা যায় আমাদের হাত থেকে ফস্কেই গেছে। হতবুদ্ধি পাবলিকের এলোমেলো কথাবার্তা শুনে ও কোনদিকে এগোচ্ছে বোঝার কোন উপায় নেই। সুতরাং কয়েকশো মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে সে যে কোথায়, সেটা বলা নিতান্তই অসম্ভব।" তরুণ বলল। তারপর একটু ভেবেচিন্তে যোগ করল, "এক যদি ওর সম্ভাব্য গন্তব্য সম্বন্ধে কোন আইডিয়া করা যায়!"

"জোর করে বলতে পারি না।" অরণি বলল,"তবে আমার অনুমান – স্রেফ অনুমান – কিম্ভুত হয়ত রাজস্থানের থর মরুভূমির দিকে চলেছে। থর হচ্ছে ভারতের সবচাইতে উত্তপ্ত জায়গা। অন্ধ অনুভূতির তাড়নায় অঢেল সৌরশক্তির ঐ উৎসের দিকেই হয়তো ব্যাটা ছুটে চলেছে।"

"হেলিকপ্টার রাজস্থানের দিকে ঘোরাও।" তরুণ পাইলটকে নির্দেশ দিল। তারপর চটপট ওয়্যারলেসে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

সামনে তাকালে চোখে পড়ে, অনেক দূরে নীচে ধু-ধু বালির রাশি। সূর্যের কিরণ তার ওপর ঝলসাচ্ছে। তরুণের শক্তিশালী বাইনোকুলার তার মধ্যে বৃথাই একটি কালো বিন্দু খুঁজে মরছিল। সে ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছিল।

"হয় তোর অনুমান ভুল, নয়তো সে এখনও এসে পৌঁছোয়নি।" হতাশ ভঙ্গীতে তরুণ বলল। বলতে বলতেই হঠাৎ তার চোখ চকচক করে উঠল। হলুদ বালির সমুদ্রের মধ্যে সে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে একটি সন্দেহজনক বিন্দু। সেটা তখনও বিশ-ত্রিশ মাইল সামনে।

"মনে হয় ব্যাটাকে পেয়েছি।" বলে তরুণ পাইলটকে সেদিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। তারপর সহযোগীদের দিকে চেয়ে বলল,"তরল নাইট্রোজেন স্প্রে করার যন্ত্র রেডি রাখ। পাইলট, এবার তুমি ওটার ওপর হেলিকপ্টার নামিয়ে এনে ধীরে ধীরে পাক খেতে থাকবে। তবে খুব নীচুতে নয়, ব্যাটা লাফাতে পারে। পঞ্চাশ ফুট অবধি নামলেই চলবে, ওখান থেকে আমরা স্প্রে করব।"

এমন সময় ওয়্যারলেস রেডিওয় এক কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "অচেনা বায়ুযান, তোমার পরিচয় জানাও। তুমি সামরিক এলাকায় ঢুকতে চলেছ।"

তরুণ সাথে সাথে গোপন কোড বিনিময় করল। তারপর বলল, "আমরা এক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মিশনে বেরিয়েছি, অপেক্ষা করার সময় নেই। তাড়াতাড়ি আমাদের এগোবার অনুমতি দাও।"

"আজ নয় – এই এলাকায় আজ কোনও স্থলযান বা বায়ুযানের ঢোকার অনুমতি নেই।" সামরিক কম্যাণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।

"কিন্তু আমাদের থামলে চলবে না। আমরা এক বিপজ্জনক শত্রুকে ধরতে বেরিয়েছি আর আমাদের সাফল্যের ওপর হাজার হাজার জীবন নির্ভর করছে।"

"দুঃখিত – তোমাদের ফিরে যেতেই হবে। কোন কারণেই কোন ব্যতিক্রমের নির্দেশ নেই।"

"জানো, আমাদের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন আছে!" তরুণ তড়পায়।

"সরি, বস – প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন থাকলেও আমি তোমাকে যেতে দিতে পারব না। ফিরে যাও, নইলে গুলি চলবে।"

তরুণ দাঁতে দাঁত পিষে অচেনা রক্ষীটির উদ্দেশ্যে চোখা চোখা কিছু গালিগালাজ বর্ষণ করল। কিন্তু সাথে সাথে পাইলটকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল, "খেল খতম – হেলিকপ্টার ঘোরাও!" তারপর হতাশ দৃষ্টিতে পেছন ফিরে দেখতে লাগল কালো বিন্দুটি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ফুর্তিতে এগিয়ে চলেছে, ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।

তখনই সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা ঘটল। হঠাৎ তাদের সামনের দিগন্ত যেন শত সূর্যের দীপ্তিতে দেদীপ্যমান হয়ে উঠলো। সেই অদৃশ্যপূর্ব জ্যোতিতে তাদের চোখ অন্ধ হবার উপক্রম হ'ল। পৃথিবী যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল, বায়ুস্তরেও তার ছোঁয়ায় লাগল প্রবল ঝড়ের দাপট। তারপরই এক অপার্থিব গুরুগম্ভীর আওয়াজে তাদের কানে তালা লেগে গেল। অভিজ্ঞ পাইলট যে কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে হেলিকপ্টারকে আকাশে ধরে রাখতে পারল তা সে-ই জানে!

"অ্যাঁ – ওটা কী হ’ল? কিছু বুঝলি?" হতভম্ব অরণি তার কম্যাণ্ডো বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল।

"বোধহয়।" তরুণ তিক্ত হাসি হেসে বলল,"ভারত থর মরুভূমিতে তার দ্বিতীয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাল। কী পোড়াকপাল – পঁচিশ বছর পর ঠিক এখন আর এখানে না হলেই চলছিল না!"

কিন্তু অরণির মুখ ততক্ষণে খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, "বরং তার জন্য আনন্দ কর। সমস্যার সমাধান – কিম্ভুত খতম! পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণী নেই যা ফিউশন বোমা হজম করতে পারে। সত্যি বলতে কী, আমার সন্দেহ ছিল সামান্য তরল নাইট্রোজেন স্প্রে এই দানবকে কাত করতে পারবে কিনা। ভগবান মঙ্গলময় – হয়তো ওটাকে শেষ করার এই একমাত্র উপায় ছিল।"

"সত্যিই তো – কী বোকা আমি, এটা খেয়াল করিনি!" তরুণ এতক্ষণে ফুর্তিতে টগবগ করে উঠল। যোদ্ধারা পরস্পরের মধ্যে 'হাই ফাইভ' বিনিময় করল। এক বিরাট ফাঁড়া কেটেছে! সেই খুশিতে হেলিকপ্টার নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছনোর অপেক্ষা না রেখে আকাশেই খাদ্য-পানীয়ের উৎসব শুরু হয়ে গেল।

পৃথিবীপৃষ্ঠের কয়েকশো ফুট নীচে লক্ষ লক্ষ টন মাটি আর বালির স্তুপের তলায় একটি বিচিত্র অস্তিত্ব অনেক চেষ্টায় একটু গা ঝাড়া দিল। খাদ্য, কী বিপুল পরিমাণ খাদ্য – যেন খাদ্যের এক প্লাবনে তার দম আটকে মরার অবস্থা হয়েছিল। তারপর যে কত দিন, কত মাস কেটে গেছে হিসেব রাখার ক্ষমতা তার নেই। শুধু জানে, এতদিনে সে তার নতুন পরিবেশ ও আমূল পরিবর্তিত রূপে কিছুটা ধাতস্থ হতে পেরেছে।

তার শক্তির খিদে অবশ্য মেটেনি। বরং বর্দ্ধিত আয়তনের অনুপাতে বেড়ে তা এখন হয়েছে আকাশছোঁয়া। তার সহজাত অ্যানটেনা তাই দিকে দিকে সঙ্কেত পাঠিয়ে চলেছে – বিপুল শক্তিভাণ্ডারের খোঁজে।

শেষ অবধি একদিন সন্ধান এল। তার অনুভূতির সীমান্তে পৃথিবীর গভীরে কোথাও দুটো টেকটনিক প্লেট ধীরে ধীরে পরস্পরের গা ঘষাঘষি করে অমিত পরিমাণে শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারদিকে। শক্তিভুক কিম্ভুত জীবটি ইঞ্চি ইঞ্চি করে তার দানবিক অস্তিত্বকে সেই দিকে টেনে নিয়ে চলে। লাগুক সময়, একদিন সে পৌঁছোবেই।


ছবিঃদাড়িদা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা