পত্রিকার অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে পাঠক-প্রতিক্রিয়ারও একটি বিভাগ থাকত যেখানে সম্পাদক পাঠকদের প্রশ্ন-পত্রের উত্তর দিতেন। দেখা যায় বহু ক্ষেত্রে পাঠকের রাগী প্রতিক্রিয়া কিংবা কটুকথার উত্তরেও সম্পাদক শিবনাথ শাস্ত্রী কৌতুকপূর্ণ এবং সরস উত্তর দিতেন। কখনও ক্ষোভের উত্তরে পালটা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। এও এক মহৎ গুণ বলেই মনে হয়। তোমারও হয়ত অনেক কিছু দেখেই রাগ হ'তে পারে, কিন্তু ভেবে দেখো যে পালটা রাগ দেখালে তার কোন সমাধান আদৌ সম্ভব কি না। যদি না হয়, তাহলে রাগ দেখিয়েও কোনও মানে নেই… উলটে নিজেরই মাথা গরম আর শরীর খারাপ হওয়ার উপক্রম। আরও মজার কথা কি জানো? আমাদের মাথা গরম হয়ে গেলে, আর আমরা তখন ভাবতেই পারি না। মাথা গরম অবস্থাতেই যা করার করি, যা বলার বলি… পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে টের পাই, সে সব কিছুই হয়ত দরকার ছিল না। যাই হোক, সুযোগ্য সম্পাদক শিবনাথ শাস্ত্রীর পরে এই পত্রিকার দায়িত্ব নাম হেমচন্দ্র সরকার। এবং এরপরে আরও কয়েকজনের সম্পাদনায় 'মুকুল' বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকাশিত হ'তে থাকে। এখানে বলে রাখা ভাল অন্যান্য পত্রিকার মত মুকুল পত্রিকা নিজের মূল কর্মকর্তাদের 'পরিচালকমণ্ডলী' বলত না, বলা হ'ত 'সম্পাদকমণ্ডলী'।
হ্যাঁ, একটা ভারী মজার জিনিস দিয়ে এই 'মুকুল' পত্রিকার গল্প শেষ করব। 'মুকুল' পত্রিকা - ১৩০৩ বঙ্গাব্দ, জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় একজন বালক কবি তার স্বরচিত কবিতা প্রকাশ করার সুযোগ পায়। সেই বালক কবির নাম শ্রীসুকুমার রায় চৌধুরী (বয়স ৮ বছর)। কবিতাটি এইখানে রেখে দিলাম তোমার জন্য, পড়ে দেখো কেমন লাগে। আর মনে করে দেখো তো এই বালক কবিটি কে চিনতে পার কি না? 'নদী' নামের সেই কবিতাটি তোমার জন্য এইখানে দিয়ে দিলাম, পত্রিকা থেকে।
সেই ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের 'দিগ্দর্শন' পত্রিকা থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দী ধরে এগোতে এগোতে একদম শেষে এসে দেখে যায়, সত্যিই এ কি সুন্দর একটা বিবর্তন... ধীরে ধীরে কেমন পূর্ণতা পেয়ে আধুনিক রূপের দিকে এগোচ্ছে শিশু-কিশোরদের জন্য সাময়িক পত্রিকাগুলো। এবং একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে কী ভাবে জায়গা করে নিচ্ছে শিশু-কিশোর সাহিত্য। এক এক করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম আসছে, পরিচিতি তৈরী হচ্ছে শিশু-কিশোর সাহিত্যিক হিসেবে। সেইসব গল্পকার, বা কবিদের নাম আমরা খুঁজছি যাঁদের সেই সব কাজ ছোটদের মাঝে আজও সমান জনপ্রিয়! কিছু পত্রিকায় এমন নামও এসেছে, যাঁরা তখন সব শুরু করেছেন লেখা, অথবা পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন... পরবর্তীকালে, মানে বিংশ শতাব্দীতে এসে তাঁদের সৃজনক্ষমতার আসল চেহারাটা দেখা যাবে। যে ব্যক্তি একের পর এক সাজিয়ে বছর ধরে ধরে এই পত্রিকাগুলো পড়ার সুযোগ পেয়েছে, না জানি সে কত তৃপ্তিই না পেয়েছে এই কাজ করতে গিয়ে। ভাব, একটা গোটা ঘর ভর্তি বই, আর তাতে ছোটদের মন মাতানো সুন্দর সুন্দর কবিতা, ছড়া, গল্প, ধাঁধাঁ, ছবি... পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে... যত চাও তত পড়, শেষ নেই... উফফ! তবে এই ঘটনাবহুল উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এলো অবশেষে, এবং একদম শেষে এসে ১৯০০ সালে বসন্তকুমার বসু নামে এক ব্যক্তি প্রকাশ করলেন মাসিক পত্রিকা 'প্রকৃতি'। সম্পাদকের দাবী এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ ছিল বাংলা ভাষার চর্চা। লেখাগুলি পড়লে বোঝা যায়, এদের উদ্দেশ্য ছিল নীতি আলোচনা এবং 'এথিক্স' নির্ভর উপদেশ দান। এই পত্রিকায় দেখা যায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের কবিতা, প্রবন্ধ গল্প। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সকলের কাছে প্রিয় হয়েছিলেন তাঁর বই 'ঠাকুরমার ঝুলি'-র কারণেই। কিন্তু 'প্রকৃতি' পত্রিকায় লেখার সময় সেই বই তখনও প্রকাশিত হয়নি। এবং এই পত্রিকার লেখাগুলি থেকেও 'ঠাকুরমার ঝুলি'র দক্ষিণারঞ্জনকে চেনা যায় না। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং কুমুদরঞ্জন মল্লিকেরও রচনা দেখা যায় এই পত্রিকার সংখ্যাগুলোতে। আরও একটি জিনিস নজরে আসে, প্রতিষ্ঠিত শিশু-পাঠ্য সাময়িক পত্রিকাদের মধ্যে 'প্রকৃতি' পত্রিকাতেই প্রথম কোনও মুসলিম কবি বা লেখকের নাম দেখা যায়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি মোজাম্মেল হক, এবং বিশিষ্ঠ প্রবন্ধকার আবদুল করিম। এই পত্রিকাটি মোটামুটি জনপ্রিয় হয়েছিল, এবং চার বছর প্রকাশিত হয়েছিল।
এরপর যে বিংশ শতাব্দী… মানে ১৯০০ সালের পর থেকে আরও একশো বছর, সে এক বিশাল সময়। এবং বই ছাপানো, ছবি ছাপানোর প্রযুক্তিও যেমন এই সময় দ্রুতগতিতে পালটে ধাপে ধাপে উন্নত থাকে; সেরকমই পালটে যেতে থাকে শিশু-কিশোর সাহিত্যে লেখার ধরণ এবং পত্রিকার চেহারাগুলিও। সেই পালটে যাওয়ার ইতিহাস, কারা কারা ছিলেন সেই সব প্রণম্য মানুষ যারা ছোটদের বাংলা সাহিত্য পত্রিকাগুলিকে আরও সুন্দর করে তুললেন… সেও অনেক গল্প আর খুব সুন্দর এক অধ্যায়। তবে আজ সে সব কথা থাক, সেই গল্প নিয়ে অন্য একদিন জমিয়ে বসা যাবে, কেমন? এখন বরং তুমি দেখো এই যে এত পত্রিকার নাম বললাম, এতগুলো গুণী মানুষের নাম বললাম , এদের সবাই কে চিনতে পার কি না! যারা চেনা ঠেকছে না, বড়দের কাছে গিয়ে একটু খোঁজ খবর নাও, দেখবে তাঁদের সম্বন্ধে জানতে কি ভাল লাগছে তখন! বড়রাও দেখবে কেমন খুশি হচ্ছেন তোমার এই জানার আগ্রহ দেখে। আর হ্যাঁ, সুযোগ পেলে কিংবা কোনও ভাবে হদিশ পেলে অবশ্যই সেই সব পুরনো বইগুলো থেকে পাতা উলটে গল্প, কবিতা, ছড়াগুলো পড়ে দেখো… দেখবে কি ভালই না লাগছে সেই সব লেখা পড়তে! ঠিক যেমন সেই সব পত্রিকায় প্রাইজ থাকত, বলা কি যায়… হয়ত আজকের দিনে সেই সব পত্রিকার কথা তুমি যা জানো, সেই গল্প শুনিয়েই কারও কাছ থেকে দারুণ একটা প্রাইজ পেয়ে গেলে?!
থিম ছবিঃ পার্থ মুখার্জি
অন্যান্য ছবিঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, অবসর,পিক্সাবে
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সায়রী মুখোপাধ্যায় এবং সৌরভ দত্ত