খেলাঘরখেলাঘর

মান্তুর জাদু ছক্কা
ভোর হয়েছে। রাতের মায়াবী পর্দা সরে গেছে। মানতু চোখ খুলে দেখলো, সেই ছক্কাটা হাতের কাছেই রয়েছে। সে খোলামনে ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলো। কাল রাতে যা শুনেছে তা কি স্বপ্ন, না সত্যি? এ জিনিসটির কি সত্যিই কোনো যাদু ক্ষমতা আছে, নাকি কোনো আজেবাজে জিনিস কেউ ফেলে রেখে গেছে?
“কিন্তু আমি ব্যাপারটা সত্যি বলে বিশ্বাস করলেই বা ক্ষতি কী?” মানতু শেষ অবধি সিদ্ধান্তে এলো, “উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পরিশ্রম করলে তো খারাপ কিছু হতে পারে না। আর এই মুহূর্তে কিছু টাকা রোজগার করে কাকা-কাকীমাকে সাহায্য করার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য আমার আর কী হতে পারে?”
এই কথা ভেবে ছক্কাটাকে হাতে ধরে সে একটু অন্যমনস্কভাবে পথ চলছে। এমন সময় দেখলো একটা ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে। ভালো করে তাকিয়ে বুঝলো, ঘোড়াটি ক্ষেপে গিয়ে বেপরোয়া লাফঝাঁপ করছে আর পিঠে তার সওয়ার পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হবার ভয়ে সিঁটিয়ে কোনমতে লাগাম ধরে ঝুলে আছে।
কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই মানতু সেই ছুটন্ত ঝড়ের সামনে লাফিয়ে পড়লো। তাকে দেখে জন্তুটার গতি যেন এক মুহূর্তের দ্বিধায় জড়িয়ে গেলো। সেটুকু সুযোগকে কাজে লাগিয়েই আরোহী আপ্রাণ চেষ্টার পর ঘোড়াটিকে আবার আয়ত্তে নিয়ে এলো। মানতু ওর পিঠে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিলে লাগলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেলো জন্তুটা।
“বাহাদুর ছেলে!” ঘোড়ার সওয়ার মানতুর পিঠ চাপড়ে বললেন, “নিজের জীবন বিপন্ন করে তুমি আমাকে গুরুতর দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেছো। এবার বলো, আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি?”
কিছুক্ষণ দ্বিধা-সঙ্কোচের পর মানতু অবশেষে বলতে পারলো যে তার কিছু অর্থ উপার্জন করা খুব দরকার আর তার জন্য সে কিছু খুচরো কাজ খুঁজছে।
“কিন্তু তোমার তো এখনো কাজ করার মতো বয়েস হয়নি।” আরোহী বললেন, “তবে আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি আর এ ব্যাপারে তুমি ঠিক লোকের কাছেই সাহায্য চেয়েছো। আমি একটা যাত্রাদলের মালিক। আমরা কয়েক দিন আগে যাত্রার পালা করবার জন্যে এই শহরে এসেছি আর অন্ততঃ মাসখানেক এখানেই থাকবো। এই ঘোড়াটাও কিছুক্ষণের জন্য যাত্রায় নামবে, তাই ওকে তালিম দেওয়া দরকার। সেই জন্যে আজ সহিসকে ছুটি দিয়ে আমি ওকে নিয়ে পড়েছিলাম। ঘোড়াটা শিক্ষিত, কিন্তু কী যেন দেখে ক্ষেপে উঠেছিলো। বড় বিপদ হতো, যদি তুমি এসে না পড়তে।
“তা, আমি খুচরো ফাই-ফরমাস খাটার জন্য একজন বিশ্বাসী ছেলে খুঁজছিলাম। তুমি চাইলে এখন থেকে সে কাজ তুমিই করবে। স্টেশনের কাছের ময়দানে আমাদের তাঁবু পড়েছে। আজ বিকেলে তাহলে সেখানে গিয়ে আমার সাথে দেখা ক’রো।”
যাত্রার মালিক ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে গেলেন আর মানতু উৎসাহে ফুটতে লাগলো। ছক্কাটি পাওয়ার পর সবে কয়েক ঘণ্টা কেটেছে, এর মধ্যেই তার প্রথম ইচ্ছেটা সফল হতে চলেছে!

সেদিন সন্ধ্যেয় মানতু যাত্রার মালিক দত্তবাবুর সাথে যাত্রার তাঁবুতে গিয়ে দেখা করলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাকা শেষ অবধি তাকে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। দেখা গেলো মালিক হিসেবে দত্তবাবু খুবই দয়ালু। তিনি মানতুকে হালকা কাজই দিতেন। তবে তাকে খুব বিশ্বাস করতেন দেখে প্রায়ই টাকা লেনদেনের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তার হাতে ছাড়তে দ্বিধা করতেন না।
মানতুর অবশ্য সবচেয়ে ভালো লাগতো রাঘবের কাজে সাহায্য করতে। রাঘব যাত্রার দৃশ্যপট আঁকতো। মানতু তার ফাই-ফরমাস খাটতো আর সুযোগ পেলেই বসে বসে তার আঁকা লক্ষ করতো। দুঃখের বিষয়, রাঘব মানতুর প্রতি মোটেই সদয় ছিলো না। ছুতোয়-নাতায় সে মানতুকে হেনস্থা করতো। তার দুর্ব্যবহার অবশ্য মানতু গায়ে মাখতো না। সে দৃশ্যপটগুলির দিকে তাকিয়ে ভাবতো, কবে সে-ও অমন আঁকতে পারবে।
একদিন দুপুরে রাঘব খেতে গেছে আর মানতুকে বসিয়ে রেখে গেছে তার আদ্ধেক আঁকা একটা ছবির সামনে। দেখতে দেখতে মানতু ভাবছে, “আহা রে, আমি যদি এমন করে ছবি আঁকার সুযোগ পেতাম তো দেখিয়ে দিতাম আমিও কেমন পারি।” ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার গা কেমন শিরশির করে উঠলো। ঝট করে তাকিয়ে দেখে, নিজের অজান্তেই সে যাদু ছক্কাটা কখন হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছে।
হঠাৎ মনে হলো কে যেন তাকে বলছে – সুযোগ কেউ দেয় না মানতু, সুযোগ তৈরি করে নিতে হয়। চমকে এদিক-ওদিক তাকায় মানতু – কই, কেউ তো নেই! এবার সে ভালো করে দৃশ্যপটের দিকে মন দেয়। একটা পাহাড়, তার ওপরে আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। আর পাহাড়ের গা বেয়ে সামনে এসে পড়েছে এক বহতা নদী। চমৎকার!
তবে নদীর জলে যেন ঠিক স্রোতের উদ্দামতা নেই। কী মনে হয়, রং-তুলি হাতে তুলে নেয় মানতু। তারপর ধীরে ধীরে নদীর বুকে আলতো তুলির টানে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করতে থাকে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না, হঠাৎ এক ক্রুদ্ধ গর্জনে তার সম্বিত ফেরে। ঝট করে পেছন ফিরে দেখে, রাঘব দাঁড়িয়ে। রাগে তার চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
“হতচ্ছাড়া ছোঁড়া, আমার ছবিটার বারোটা বাজিয়ে দিলি! তোকে আজ দেখাচ্ছি!” বলে রাঘব ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে যায়। একটু পরই সে মালিক দত্তবাবুকে টানতে টানতে সেখানে নিয়ে আসে। অবাক দত্তবাবু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন, এমন সময় হুড়মুড় করে সেখানে ঢোকে কয়েকজন পুলিশ কনেস্টবল আর একজন ইনস্পেক্টর। তাদের দেখে রাঘব দৌড়ে পালাতে যায়, কিন্তু তার আগেই কনেস্টবলদের শক্ত বাহুবন্ধনে সে ধরা পড়ে গেছে।
জানা গেলো, লোকটা একজন কুখ্যাত অপরাধী আর এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। সুযোগ পেলেই মালিককে ফাঁক করে সে আবার লম্বা দিতো। সময়মতো খবর পেয়ে পুলিশ এসে পড়ায় বেঁচে গেলেন দত্তবাবু।
“তবুও তো আমার বারোটা বাজলো!” কপাল চাপড়ে বললেন দত্তবাবু, “এই ছবিটা এখন শেষ করবে কে? আজ সন্ধ্যের পালার জন্যে যে এটা আমার চাই।” তারপর তিনি ছবিটার দিকে ফিরে তাকালেন আর দেখতে দেখতে তার মুখে ফুটে উঠলো অবাক বিস্ময়ের ছাপ।
“ওই নদীর জলের ভেতরকার কারুকার্যটা কে করেছে?” তিনি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে, আমি”, কুণ্ঠিত মানতু উত্তর দিলো।
“অসাধারণ!” দত্তবাবু প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন আর পরমুহূর্তেই বিস্মিত মানতুকে বুকে টেনে নিলেন। বলা বাহুল্য, মানতুই এরপর ছবিটা শেষ করলো আর সেটা সবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও অর্জন করলো।
এভাবে মানতুর আর একটি মনোবাসনাও পূর্ণ হলো – তার গোপন শিল্পীপ্রতিভা স্বীকৃতি পেলো। মানতুর কাকার সম্মতি নিয়ে দত্তবাবু তাকে যাত্রাদলের প্রধান চিত্রশিল্পী হিসেবে নিয়োগ করলেন। অবশ্য মালিকের সদয় সহযোগিতায় সে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে লাগলো।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।