সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

১৯১৪ সালের মাঝামাঝি শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ চলে চার বছর ধরে । এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অনেক দেশ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানারকমের পালাবদল ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমেরিকা সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায় নি বরং নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল। আমেরিকার সাধারণ মানুষেরাও সেটাই চেয়েছিলেন। এই যুদ্ধে বৃটেন জার্মানির বিপক্ষে ছিল, বৃটেনের সাথে আমেরিকার বড় বড় বাণিজ্যিক লেনদেন চলত।চার্লি চ্যাপলিন নিজে তখন কাজের সূত্রে আমেরিকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন। ১৯১৪ সালের শুরুর দিকে ট্র্যাম্পের আবির্ভাবের পর থেকে বছর খানেকের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট সফল, ধনী এবং বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তিনি তো আসলে ছিলেন বৃটেনের নাগরিক। তাই যুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৬ সালে বৃটিশ সংবাদমাধ্যমগুলি লিখতে শুরু করে যে চ্যাপলিনের উচিত বৃটেনে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগদান করা, যদিও তখনো সে দেশে যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। চ্যাপলিন নিজের রোজগারের অনেকটা অংশ যুদ্ধে সাহায্যের জন্য দেশে পাঠাতে থাকেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে তা সত্বেও সমালোচনার শেষ ছিল না। যুদ্ধে যোগদান না করার জন্য তাঁকে বিদ্রুপ করে সাদা পালক * পাঠানো হতে থাকে। চার্লি চ্যাপলিনের কাছে এ ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ- একদিকে তাঁর সৃষ্ট গরীব, বেকার, ভবঘুরে চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্র; অন্যদিকে তিনি নিজেও ছিলেন খ্যাতির সাথে সাফল্যের চূড়ায়। এই দুই বিপরীতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যই ধীরে ধীরে ছোট্ট ভবঘুরেটির চরিত্রের মধ্যে পরিবর্তন আসে- সেই সময়ের অন্যান্য সিনেমার ভবঘুরে চরিত্রগুলির মত সে শুধুমাত্র চুরি বা মারামারি করে না, অথবা নিছক মজার জন্য কাউকে হেনস্থা করে না; তার মধ্যে দেখা দেয় সমবেদনা এবং সহানুভূতির মত লক্ষণগুলি। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর সাধারণ মানুষের ভালবাসা তার প্রতি বাড়তেই থাকে।

'শোল্ডার আর্ম্‌স্‌' ছবির পোস্টার
'শোল্ডার আর্ম্‌স্‌' ছবির পোস্টার

কিন্তু বৃটিশ সংবাদমাধ্যমগুলি যদিও চ্যাপলিনের সাথে বিরূপ ব্যবহার করেছিল, যাঁরা আসলে যুদ্ধে গেছিলেন, তাঁরা কিন্তু চ্যাপলিনের ওপরে রেগে ছিলেন না। সেই সময়ে আমেরিকার বিভিন্ন হাসপাতালের ঘরগুলির ছাদে প্রোজেক্ট করে চ্যাপলিনের ছবি দেখানো হত, যাতে যুদ্ধে আহত সৈনিকেরা, শারিরীক কষ্টের মধ্যেও, বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই একটু আনন্দ পেতে পারেন । এমনও জানা গেছে যে বৃটিশ সৈন্যরা কোন এক সময়ে 'ট্র্যাম্প'-এর একটা বড় কাট-আউট নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের পরিখার ওপর দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত, যাতে জার্মান সৈন্যরা হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে মরে যায়। ১৯১৭ সালে জার্মানির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আমেরিকা নিজেই বৃটেনের পক্ষে থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই সময়ে চ্যাপলিন নিজে সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে যান। কিন্তু তাঁর ওজন ও উচ্চতা কম ছিল বলে সেনাবাহিনীতে তাঁকে নেওয়া হয়নি।

১৯১৮ সালে ট্র্যাম্পকে নায়ক বানিয়ে চ্যাপলিন তৈরি করে যুদ্ধের পটভূমিকায় ছবি 'শোল্ডার আর্মস্‌'। এই ছবিতে দেখা যায়, ট্র্যাম্প যুদ্ধে যোগদান করে ফ্রান্সে চলে গেছে। সেই সময়ে যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের মুখে, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত একটা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি করা এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষ ট্র্যাম্পকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন।

সিটি লাইট্‌স্‌ ছবির একটি দৃশ্য
'সিটি লাইট্‌স্‌' ছবির একটি দৃশ্য

১৯৩১ সালে তৈরি সিটি লাইট্‌স্‌ ছবিটিকে বলা হয়ে চ্যাপলিনের তৈরি অন্যতম সেরা ছবি। এই ছবিতে আরেকবার ট্র্যাম্পই নায়ক। এই ছবি যখন তৈরি হয়, তার দুয়েক বছর আগে হলিউডে সিনেমায় শব্দ সংযোজনা করা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু চ্যাপলিন নিজের ছবিতে শব্দ ব্যবহার করতে চান নি। তিনি জানতেন, তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রটিকে কোন গলার স্বর বা ভাষা দেওয়া ঠিক হবে না। তার নিজস্ব কোন ভাষা বা গলার স্বর নেই বলেই সে সারা বিশ্বের সর্বত্র সমান জনপ্রিয়। প্যান্টোমাইম ঘরানায় অভিনয়ের গতি এবং মেজাজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট। সেই ছোট্ট ভবঘুরে যদি হঠাৎ ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে, তাহলে সে আন্তর্জাতিক দর্শকদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের ভালবাসা হারাবে। তাছাড়া সে ঠিক কিভাবে কথা বলবে? তার গলার আওয়াজ কিরকম হবে- সেটাও তো ভাবার ছিল- কারণ প্রতিটি দর্শক তো তার নিজের মত করে চরিত্রটির গলার আওয়াজ মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছে। তাকে তিনি মাত্র একটা গলার আওয়াজ, একটা ভাষা দেন কি করে?

'সিটি লাইট্‌স্‌' ছবিতে তাই নেপথ্য সঙ্গীত এবং আরো দুই-একটি শব্দের ব্যবহার থাকলেও চ্যাপলিন কোন সংলাপ ব্যবহার করেন নি। বরং তিনি সারা দুনিয়াকে চমকে দিলেন পুরো ছবির নেপথ্য সঙ্গীত সৃষ্টি করে।

'সিটি লাইট্‌স্‌' এর টাইটেল কার্ডেই শেষ দেখা যায় 'এ ট্র্যাম্প' বলে ভবঘুরে চরিত্রটির ভূমিকায় চার্লি চ্যাপলিনের নাম। কিন্তু ট্র্যাম্পকে একেবারে শেষবারের মত দেখা যায় ১৯৩৬ সালে তৈরি 'মডার্ন টাইম্‌স্‌ ' ছবিতে। সেখানে তার পরিচয় একজন কারখানার শ্রমিক। এই ছবি যখন তৈরি হচ্ছে, সেই মূহুর্তে ট্র্যাম্পের প্রথম আবির্ভাবের সময়কে পেছনে ফেলে দুনিয়া এগিয়ে গেছে আরো দুই দশক। আর তিন বছর পরেই শুরু হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার জীবন শুধু আর আধুনিক যুগের গরীব মানুষদের সমস্যায় ভরা নয়। কুড়ি বছরের তফাতে সে দেখেছে আমেরিকার ভয়াবহ মন্দার বাজার, বেকারত্বের সমস্যা, আর দেখেছে কিভাবে যন্ত্রনির্ভর শিল্পব্যবস্থা এসে ক্রমশঃ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের কাজ। চ্যাপলিন নিজেও এই বিষয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। সেই সময়ে বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে দেখে তিনি মন্তব্য করেন- যন্ত্র মানুষের কাজে লাগা উচিত। মানুষের জীবনে দুঃখ এনে দিয়ে তার কাছ থেজে কাজ কেড়ে নেওয়া যন্ত্রের পক্ষে উচিত নয়।

মডার্ন টাইম্‌স্‌ এর পোস্টার
'মডার্ন টাইম্‌স্‌' এর পোস্টার

এইসব ভাবনা চিন্তাকেই কমেডির মোড়কে পুরে ১৯৩৬ সালে তৈরি হল 'মডার্ন টাইম্‌স্‌'। যান্ত্রিক সভ্যতার নানা সমস্যা- বেকারি, দারিদ্র্য, ধর্মঘট, আন্দোলনকারী, রাজনীতি ও অর্থনীতির হরেক সমস্যাগুলির মাঝখানে, মডার্ন টাইম্‌স্‌ এর সেই ছোট্ট চেহারার কারখানা শ্রমিককে দেখা গেল যন্ত্রের সাথে অমানুষিক লড়াই করতে। কারখানার মালিক সময়কে আরো বেশি কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে এলেন আরেক যন্ত্র, যেটি নিজেই শ্রমিককে খাইয়ে দেবে, তাকে আর দুপুরের খাওয়ার জন্য আলাদা করে কর্মবিরতি দিতে হবে না। সেই যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য বেছে নেওয়া হল সাদাসিধে সেই শ্রমিককে। তারপরে সে সাঁড়াশির মত যন্ত্রের কবলে পড়ে বেচারা যত নাকাল হল, সেসব দেখে আমরা খুব হাসি ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তার অসহায় জীবনের কথা ভেবে কষ্টও পাই।

'সিটি লাইট্‌স্'‌-এর মত 'মডার্ন টাইম্‌স্'‌-এও চ্যাপলিন নিজেই ছবির সঙ্গীত এবং শব্দ পরিকল্পনা করেন। এই ছবিতেই ট্র্যাম্পকে শেষবারের মত দেখা যায়, আর একমাত্র এই ছবিতেই ট্র্যাম্পের মুখে খানিক্ষণের জন্য চ্যাপলিনের গলা শোনা যায়, যখন সে একটা রেস্তোরাঁতে বানিয়ে বানিয়ে একটা গান করে।

এই ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ট্র্যাম্প এবং তার সঙ্গিনী হাতে হাত ধরে হাঁটা দেয় দূর দিগন্তের দিকে। "আমরা ঠিক চালিয়ে নেব..."- এই বিশ্বাসে বুক বেঁধে এই দুই বাঁধনহারা প্রাণ পাড়ি দেয় অজানার উদ্দেশ্যে।


আ ডগ্‌স্‌ লাইফ ছবির একটি দৃশ্য
'দ্য কিড' ছবির একটি দৃশ্য

একশো বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তার পথচলা আজও শেষ হয়নি। সেই ছোট্ট ভবঘুরে আজও হেঁটে চলেছে, আর সাদা-কালো সিনেমার পর্দার থেকে হাত বাড়িয়ে মাঝে মধ্যেই মুছিয়ে দিচ্ছে কারো চোখের জল, নানারকমের হাবভাব করে কারোর গোমড়া মুখে এনে দিচ্ছে হাসি, অথবা কারোর মনখারাপ হলে চুপচাপ পাশে বসে থেকে ভাগ করে নিচ্ছে তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট। শুধুমাত্র তার চোখের ভাষা, মুখের হাসি আর নানারকমের কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে, একটাও কথা না বলে, সে হয়ে উঠেছিল সারা পৃথিবীর সব বয়সী মানুষের কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব আজও আছে অটুট।






(সাদা পালক* - অষ্টাদশ শতকের পর থেকে, যারা যুদ্ধে যেতে ভয় পেত, তাদের বিদ্রুপ করার জন্য বৃটেনে সাদা পালক ব্যবহার দেওয়া হত।)
(চার্লি চ্যাপলিনের বেশিরভাগ ছবিই ইউটিউবে বিনামূল্যে দেখতে পাওয়া যায়। তাই হাতে সময় থাকলে নতুন করে আরেকবার বন্ধুত্ব করে নিতে পারো আমাদের সবার প্রিয় ভবঘুরে বন্ধুর সাথে। )


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা